সক্রিয় হওয়ার এখনই সময়

টিআইবির সাম্প্রতিক জরিপে দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়েছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৫ তম অবস্থান থেকে ১৪৩ তম অবস্থানে পৌঁছেছে। এ তথ্য কিছুটা সুবাতাসের পরশ দিলেও দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা এখনো উদ্বেগজনক, যা সুশাসনের ঘাটতি ও ন্যায্যতার সংকট সৃষ্টি অব্যাহত রেখেছে।

এখনো দেশে ধনী-দরিদ্রের ও নারী-পুরুষের মধ্যে রয়েছে বিরাট বৈষম্য। লিঙ্গবৈষম্যের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জীবন মৌলিক সুবিধাবঞ্চিত রয়ে যাচ্ছে। সেখানে নারী দ্বিগুণ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। মাথাপিছু গড় আয় বা আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের তত্ত্ব দিয়ে জনগণের প্রাপ্যতা বিচার করা যায় না। বাংলাদেশে ৬৫ শতাংশ জনগণ গ্রামাঞ্চলে বাস করে, তারা সরকারের নারী উন্নয়নের নীতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দুর্বলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারণে একদিকে যেমন লিঙ্গবৈষম্য নিরসনের আদর্শগত ও বাস্তব সুবিধাভোগে বঞ্চিত, অন্যদিকে নগরায়ণের কারণে শহুরে জনগণ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগের মাধ্যমে সম্ভাবনা বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করতে কিছুটা সক্ষম। এই অবস্থা নিরসনের জন্য আমাদের শুধু লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণের ওপর গুরুত্ব দিলে চলবে না, সেই সঙ্গে শ্রেণিবৈষম্য, ধনী-দরিদ্রের সমতা স্থাপন না করতে পারলে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে একটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়া সম্ভব নয়।

স্বাধীনতার চার দশকে, বিশেষত নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশের যে অর্জন, তা বহুলাংশে ক্ষীণ হয়ে আসছে লিঙ্গবৈষম্য ও শ্রেণিবৈষম্যের কারণে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচকে যথা নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি, শিশুমৃত্যুর হার কমানো এবং গড় আয়ু বৃদ্ধি ইত্যাদিতে অগ্রগামী বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের বিস্ময়’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এসবই সম্ভব হয়েছে নারীর প্রত্যক্ষ অবদানের মাধ্যমে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশে নারী নির্যাতন বেড়ে চলেছে, বাল্যবিবাহে চতুর্থ অগ্রগামী দেশ বাংলাদেশ। যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, সহিংসতা যদিও সব নারীর জীবনে এক বিরাট হুমকিস্বরূপ, তবু সিংহভাগ গ্রামীণ নারী এ ধরনের নিগ্রহের শিকার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক ২০১৫ সালে গৃহীত এসডিজি তথা টেকসই উন্নয়নের ১৭টি অভীষ্ট লক্ষ্য ও ১৬৯টি নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জিডিপি প্রবৃদ্ধির মাপকাঠিতে বাংলাদেশ শীর্ষ দেশসমূহের অন্তর্ভুক্ত হলেও বিগত দুই বছরের মানবিক উন্নয়ন পর্যালোচনায় দেখা যায় যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি দেশে। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে, যেখানে দেশের সিংহভাগ জনগণ বাস করে, সেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার অতি নগণ্য, যা গ্রামীণ দারিদ্র্যকে আরও প্রকট করে তোলে। গ্রামাঞ্চলের সুষম উন্নয়নের জন্য সরকারের যথাযথ নীতির অভাব, সেই সঙ্গে সুশীল সমাজ ও অ্যাকটিভিস্টদের অঙ্গীকারের অভাব গ্রামীণ দারিদ্র্যকে আরও প্রকট করে তুলেছে। দেশে দুর্নীতির সূচকে সামান্য অগ্রগতি হলেও সামগ্রিক বিচারে প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত হয়নি। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে শুধু লিঙ্গ-সমতা স্থাপনই যথেষ্ট নয়; সেই সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, বিশেষত গ্রামীণ দারিদ্র্য মুক্তির পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার যে ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে, তাতে ব্যাপক অবদান রয়েছে গ্রামীণ নারীর, বিশেষত কৃষিক্ষেত্রে এবং মজুরিবিহীন শ্রমদানের মাধ্যমে, যা সিপিডির পরিচালক ফাহমিদা খাতুন তাঁর গবেষণায় তুলে ধরেছেন। নারীর প্রতি লিঙ্গবৈষম্য ও শ্রেণিবৈষম্য নিরসনের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনই।

এখনই সময় ক্ষমতাহীন নারীকে ক্ষমতায়িত করার—এ কথা বিশ্ব নারী দিবসে এ বছরের প্রতিপাদ্যে মূর্ত হয়েছে। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বিশ্ব নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা স্থাপন; প্ল্যানেট ৫০: ৫০ এবং এই প্রক্রিয়াকে উজ্জীবিত করা। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের বিশ্ব নারী দিবসের একটি প্রতিপাদ্য হলো ‘প্রেস ফর প্রগ্রেস’, যা বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে ‘প্রগতিকে দাও গতি’। আর জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও ইউএন উইমেন ফর ইন্টারন্যাশনাল উইমেনস ডের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ফুমজিলে ম্লামবো এনগুকার বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘টাইম ইজ নাউ: রুরাল অ্যান্ড আরবান অ্যাকটিভিস্টস ট্রান্সফরমিং উইমেনস লাইভস’।

এসডিজি বা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ সুশীল সমাজের মূল বক্তব্য হলো-কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না। কিন্তু এখনো দেশের সুবৃহৎ জনগোষ্ঠী পেছনে পড়ে আছে। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, পাশাপাশি দারিদ্র্যও বেড়েছে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে আমরা বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছি, কিন্তু নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। আমাদের উন্নয়নকর্মী ও অ্যাকটিভিস্টরা দেশের বাইরেও সুনাম অর্জন করেছে দারিদ্র্য ও অসমতা নিরসনে। তাই দেশ থেকে ধনী-দরিদ্র ও নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করতে হবে, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নারী-পুরুষকে একত্রে এগিয়ে আসতে হবে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় হওয়ার জন্য এবং এখনই তা করার সময়।

এ প্রসঙ্গে আরও বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার যাত্রাপথে বাংলাদেশের জন্য শুধু গ্রামীণ নারীর সক্ষমতা বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়। এখনই সময় দেশের সব নারী-পুরুষের জন্য সমতার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। এখনই সময় সামাজিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের, ক্ষমতাশীল ও পুরুষের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ করা, সমাজে বিরাজমান দুর্নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে গণতান্ত্রিক মূলবোধকে সুদৃঢ় করা, যেখানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তাদের জীবন ও জীবিকার সুষম বিকাশের সুযোগ পাবে।

সালমা খান: অর্থনীতিবিদ, নারীনেত্রী