নিষ্ঠুর মহামারি ও মমতাময়ী রওশন

রওশন আরা সাংমা।  ছবি: সংগৃহীত
রওশন আরা সাংমা। ছবি: সংগৃহীত

আমপাতি মেঘালয়ের একটি গ্রাম। ১৯৭১ সালে এটি হয়ে উঠেছিল ‘মিনি বাংলাদেশ’। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর ও নেত্রকোনার বহু মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নেয় ভারতের মেঘালয় রাজ্যে। ওপারের বাসিন্দাদের বেশির ভাগ ছিল গারো, খাসিয়া ও জৈন্তিয়া। তাদের অনেকে আবার পাকিস্তানি জমানায় এপার থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভয়, বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জায়গা দিলে তারা আর ফিরে যাবে না। স্থায়ী হয়ে যাবে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শরণার্থীরাও ছিল নিরুপায়। ফিরে গেলে পাকিস্তানি সেনারা মেরে ফেলবে। দুপক্ষের মধ্যে এ নিয়ে বাদানুবাদ চলছিল। খবর পেয়ে এগিয়ে এলেন রওশন আরা বেগম সাংমা নামের মহীয়সী এক নারী। তিনি ওই অঞ্চলের ভূস্বামী বিজয় সাংমার স্ত্রী। সবাই তাঁকে মান্য করে। তিনি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতাদের ডেকে বললেন, ‘কেউ আশ্রয় না দিলে শরণার্থীরা আমার জমিতে থাকবে।’ দনু নদের পাড়ে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তাঁর জমি।

সেদিন থেকে আমপাতি হয়ে যায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের নিরাপদ আশ্রয়। কয়েক মাসের মধ্যে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৫ হাজার। রওশন আরা তাদের শুধু থাকার জায়গা দেননি, খাবারের ব্যবস্থাও করেন। প্রতিদিন ভোরে ছয় বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে তিনি শরণার্থীদের শিবিরে যেতেন। তাঁর সঙ্গে থাকত বিশাল বিশাল পাতিল-ডেকচিতে ভরা রান্না করা খাবার। তাঁর বাড়ির লোকজন শরণার্থীদের মধ্যে সেই খাবার পরিবেশন করতেন। রওশন আরা নিজেও ছেলেকে নিয়ে তাদের সঙ্গে খাবার খেতেন। গল্প করতেন। শরণার্থীদের কার কী অসুবিধা, খোঁজ নিতেন। সাধ্যমতো প্রতিকার করতেন। তারপর বাড়ি ফিরে যেতেন। রওশন আরার বাড়ির দরজা সব সময় শরণার্থীদের জন্য খোলা ছিল। কেউ অসুখ-বিসুখে পড়লে তাঁর কাছে ছুটে যেত।

এভাবে কিছুদিনের মধ্যে রওশন আরা সাংমা হয়ে ওঠেন শরণার্থীদের আপনজন। তারা তাঁকে ‘মা-জি’ বলে ডাকত। স্থানীয় বাসিন্দারা যখন দেখলেন, শরণার্থীরা কোনো ঝামেলা করছে না, তখন তাঁরাও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেন। স্থানীয় বাসিন্দা ও শরণার্থীদের মধ্যে গড়ে ওঠে সখ্য। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সাহায্য আসা শুরু হলে গ্রামবাসীর দায় কিছুটা কমে যায়। এরপরও মা-জি শরণার্থীদের খোঁজখবর নিতেন। এভাবে কয়েক মাস চলে যায়।

জুন মাসে হঠাৎ শরণার্থী শিবিরে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে মহামারি আকারে। রওশন আরা সাংমা তখন নিজের সব কাজ ফেলে অসুস্থ রোগীদের সেবা করেন। চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। গ্রামের বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবকদের সেবা-শুশ্রূষার কাজে লাগান। এসব সত্ত্বেও মহামারিতে শরণার্থী শিবিরের সাড়ে তিন হাজার লোক মারা যায়, যাদের একটি বড় অংশ ছিল শিশু। সমাজকর্মীরা ৮০০ জনের নাম উদ্ধার করতে পেরেছেন। বাকিদের নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি। রওশন আরা শরণার্থীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতো।

বাংলাদেশের বিজয়ের পর যখন শরণার্থীরা দেশে ফিরে আসে, এই মহীয়সী নারী ও গ্রামবাসী তাদের অশ্রুসিক্ত হয়ে বিদায় দেন। রক্ত ও অশ্রুতে মেশা মুক্তিযুদ্ধের এই মানবিক গল্প তাঁর লেখায় তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক লে. কর্নেল সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ইন কোয়েস্ট অব ফ্রিডম দি ওয়ার অব ১৯৭১ নামক একটি সংকলন বইতে। আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা ব্লুমসব্যারি থেকে প্রকাশিত বইটি সম্পাদনা করেছেন মেজর জেনারেল আয়ান কারডোজো।

প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক জানান, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি আমপাতির কাহিনিটি শোনেন। এরপর সিদ্ধান্ত নেন রওশন আরা সাংমার সঙ্গে দেখা করে একবার তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবেন। সেখানকার মানুষকে ধন্যবাদ দেবেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি ২০১০ সালে ঢাকা থেকে শিলং পর্যন্ত গিয়েছিলেন। আমপাতিতে তখন উগ্রপন্থীদের উপদ্রব। তাঁকে জানানো হয়, মেঘালয় সরকারের অনুমতি ছাড়া তিনি সেখানে যেতে পারবেন না।

কে অনুমতি দেবেন?
একমাত্র মুখ্যমন্ত্রীই অনুমতি দিতে পারেন। তখন মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মুকুল সাংমা (এখনো তিনি সেই পদে অধিষ্ঠিত)। কিন্তু তখনো তাঁর সঙ্গে সাজ্জাদের পরিচয় ছিল না। মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার কথা বললেন। তাঁকে অভ্যর্থনাকক্ষে অপেক্ষা করতে বলা হলো। কিছুক্ষণ পর এক ভদ্রলোক সেখানে এসে তাঁর দেখা করার কারণ জানতে চাইলেন। সাজ্জাদ জবাব দিলেন, তিনি আমপাতি যেতে চান।

ভদ্রলোকের পাল্টা প্রশ্ন, কেন তিনি আমপাতি যেতে চান? সাজ্জাদের জবাব, সেই মহীয়সী নারীকে একবার সালাম দিয়ে আসব; যিনি একাত্তরে আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন।

ভদ্রলোক বললেন, আপনি যাঁকে দেখতে আমপাতি যেতে চান, তিনি আর বেঁচে নেই। ২০০৯ সালেই তিনি মারা গেছেন। এরপর দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আপনি যাঁর কথা বলছেন, তিনি আমার মা। আর ছয় বছরের যে শিশুর কথা বলছেন, তিনি এখন আপনার সামনে দাঁড়ানো। মুকুল সাংমার কথা শুনে সাজ্জাদের চোখে পানি চলে আসে। কৃতজ্ঞতায় তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেন, মাকে দেখতে না পেলেও সন্তানকে দেখেছি, এটাই কি কম পাওয়া?

২০১২ সালে আরও অনেকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার রওশন আরা বেগম সাংমাকে মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা দেয়।

সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক লিখেছেন, ‘আমপাতির যে শরণার্থী শিবিরে সাড়ে তিন হাজার মানুষ মারা গেছে, সেই শিবিরের স্মৃতি সংরক্ষণ করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। তারাও তো দেশের স্বাধীনতার জন্য সেখানে গিয়েছিল।’