শান্তির পদধ্বনি ও জাপানের উৎকণ্ঠা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উন

কোরীয় উপদ্বীপকে কেন্দ্র করে বিগত কয়েক দিনের তাৎপর্যপূর্ণ কিছু ঘটনা অঞ্চলজুড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা এখন হঠাৎ করেই কিছুটা হলেও বাড়িয়ে দিয়েছে। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচি বিগত কয়েক বছরে পূর্ব এশিয়াকে মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল। সেই হুমকি যে পুরোপুরি কেটে গেছে, তা অবশ্যই নয়। মাত্র কিছুদিন আগে পর্যন্ত টুইটারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিয়ে যাওয়া নিরলস বার্তা সংকটকে আরও ঘনীভূত করে চলছিল। সে রকম অবস্থায় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের শান্তির লক্ষ্যে নেওয়া পদক্ষেপ শান্তি ফিরিয়ে আনতে আসলেই সক্ষম হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠা সত্ত্বেও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট নিজের আগের অবস্থান থেকে সরে আসেননি এবং নানা রকম বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল উত্তর কোরিয়ায় পাঠিয়ে বাগাড়ম্বরের পথে না গিয়ে বরং উত্তরের সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনার ওপর অগ্রাধিকার প্রদান অব্যাহত রাখেন। তাঁর সেই শক্ত অবস্থানের ফলেই হঠাৎ করে কোরীয় উপদ্বীপের পরিস্থিতি এখন অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করেছে।
প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন কেবল পিয়ংইয়ংয়ে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েই বসে থাকেননি, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে একই কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্রে তিনি পাঠিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে ধরনা দিতে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি ছাড়া পূর্ব এশিয়ায় শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নেওয়া যেকোনো পদক্ষেপ যে ব্যর্থ হতে বাধ্য, প্রেসিডেন্ট মুনের তা ভালোভাবেই জানা আছে। তাই উত্তরের কাছ থেকে আলোচনার টেবিলে বসা নিয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়ার পর ওয়াশিংটনকে যেন সংলাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা যায়, সেই লক্ষ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিনিধিদল মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং বিস্ময়কর অগ্রগতি নিশ্চিত করে নিতে সক্ষম হয়।
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন দক্ষিণের প্রতিনিধিদলকে বলেছিলেন, কেবল দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেই নয়, সেই সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হতে তিনি প্রস্তুত আছেন। নিজের সেই প্রস্তাব যে আসলেই আন্তরিক, তা প্রমাণ করার জন্য পরমাণু পরীক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রাখার ইচ্ছাও তিনি ব্যক্ত করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পক্ষে লোভনীয় সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া এ কারণে সম্ভব হয়নি যে বিগত দিনগুলোতে নিষেধাজ্ঞা কঠোর করে নেওয়া সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যর্থতা নিরাপত্তা ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে আলোচনার মধ্য দিয়ে অগ্রগতি সম্ভব কি না, সেটা তিনি এখন হয়তো পরীক্ষা করে দেখতে চাইছেন।
সামরিক বলের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো তুলনা উত্তর কোরিয়ার হতে পারে না। তবে কথা হচ্ছে, দেশটির বিরুদ্ধে ঝটিকা হামলা চালানোর পদক্ষেপ মার্কিন সমরনায়কেরা গ্রহণ করলেও পিয়ংইয়ংয়ের হাতে থেকে যাওয়া পরমাণু অস্ত্র ভয়াবহ এক পরিণতির ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। বিশেষ করে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পিয়ংইয়ংয়ের কবজায় চলে আসায় মরণকামড় হিসেবে উত্তর কোরিয়া যে মার্কিন ভূখণ্ডে হামলা চালাতে সেগুলো কাজে লাগাবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়তো মনে করে থাকবেন যে সংলাপের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করে দেখা মন্দ প্রস্তাব নয়। আর তাই অল্প কিছুদিন আগেও উত্তর কোরিয়ার অস্তিত্ব মুছে ফেলার হুমকি দিয়ে যাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন বলছেন, তাঁর অপছন্দের সেই নেতার সঙ্গে আলোচনায় বসতে তিনি প্রস্তুত আছেন এবং মে মাসের শেষ নাগাদ সেই শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির ময়দানে হঠাৎ ঘটে যাওয়া এই অগ্রগতিকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখা যেতে পারে। মে মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই উত্তরের সঙ্গে সংলাপে বাসার প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি বলে আসছিলেন এবং প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেই পথে তিনি এগিয়ে গেছেন। তবে পূর্ব এশিয়ার সাম্প্রতিক এই অগ্রগতি সবাইকে খুশি করতে পারেনি। যারা এতে অসন্তুষ্ট এবং বিরক্তি বোধ করছে, সেই দলের নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি হচ্ছে জাপান। জাপান শুরু থেকেই বলে আসছে যে উত্তর কোরিয়া যাচাইযোগ্য উপায়ে পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বাতিল না করে দেওয়া পর্যন্ত দেশটির সঙ্গে কোনো রকম সংলাপ সম্ভব নয় এবং পিয়ংইয়ংয়ের সেই পথে নিয়ে আসার জন্য নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এমনকি জাতিসংঘের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কঠোর প্রয়োগ বাস্তবায়িত করতে সমুদ্রপথে জাহাজ থামিয়ে সেগুলোর ওপর তল্লাশি চালানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ থেকেও জাপান বিরত থাকেনি। তাই বলা যায়, জাপানের সেই কট্টর অবস্থানের কোনো রকম তোয়াক্কা না করে দক্ষিণ কোরিয়া সঠিক কূটনৈতিক চাল দেওয়ার মধ্য দিয়ে অবস্থানগত দিক থেকে টোকিওকে এখন কিছুটা বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে।
জাপানের নীতিনির্ধারকেরা আশঙ্কা করছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট উত্তর কোরিয়ার নেতার সঙ্গে আলোচনায় বসলে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি পরিহারে উত্তর কোরিয়াকে রাজি করাতে হয়তো সম্ভব হবেন। সে রকম কিছু হলে পিয়ংইয়ংয়ের হাতে থেকে যাওয়া মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র টোকিওর জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
এ ছাড়া জাপানের ক্ষমতাসীন মহল যুক্তরাষ্ট্রকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে দেখে আসায় টোকিওকে আগে থেকে কিছু না জানিয়ে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সংলাপে বসতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের রাজি হয়ে যাওয়াকেও অনেকটা যেন ঘনিষ্ঠ মিত্রের অবস্থানের অবমূল্যায়ন হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফলে সম্ভাব্য সেই সংলাপকে কীভাবে প্রভাবিত করা যায়, সেই পথের সন্ধানে জাপান এখন আছে।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে শুক্রবার সকাল নয়টার অল্প আগে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রায় ৩০ মিনিট টেলিফোনে কথা বলেছেন এবং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে প্রস্তাবিত বৈঠকের আগে আগামী মাসে তাঁর নিজের ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে উত্তর কোরিয়া নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। জাপান চাইছে সংলাপে কোনো রকম ছাড় যেন ওয়াশিংটন না দেয় এবং পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে আংশিক কোনো মীমাংসায় যেন যুক্তরাষ্ট্র রাজি না হয়। এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও বেশ কিছু পর্যবেক্ষক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তড়িঘড়ি ঘোষণায় অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এঁদের অনেকেই এখন সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, উত্তর কোরিয়ার ফাঁদে যেন যুক্তরাষ্ট্রকে আটকা পড়ে যেতে না হয়, সে জন্য সাবধানে অগ্রসর হওয়া উচিত।
দেশের ভেতর এবং বাইরে থেকে আসা এ রকম চাপের মুখে হোয়াইট হাউস এখন বলছে, শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের প্রমাণ উত্তর কোরিয়াকে দেখাতে হবে। তবে সে রকম পদক্ষেপ বলতে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে, তার কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য দেওয়া হয়নি। ফলে ধারণা করা যায় মে মাসের শেষ নাগাদ প্রস্তাবিত শীর্ষ বৈঠকের দিন ঘনিয়ে আসার আগে আরও অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে।
নানামুখী এ রকম দেনদরবার চলতে থাকলেও শান্তির এই ইঙ্গিতকে অবশ্য সার্বিকভাবে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবেই দেখা হচ্ছে। শান্তির সামান্য ইঙ্গিত সত্ত্বেও ভবিষ্যতে সেই পথে আরও কিছুটা অগ্রসর হতে পারা সহজ যে মোটেও হবে না, অঞ্চলের বিভিন্ন খেলোয়াড়ের নানামুখী এ রকম তৎপরতা সে কথাই বলছে। তবে লক্ষ্য ঠিক রেখে অবিচলভাবে যাত্রা অব্যাহত রাখলে গন্তব্যে পৌঁছানো যে অসম্ভব কিছু নয়, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মনে হয় সেটাও আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। ফলে শান্তির প্রত্যাশা এখন আমরা করতেই পারি।
মনজুরুল হক শিক্ষক ও সাংবাদিক