নারীরা রাজপথে কেন পুলিশি নিগ্রহের শিকার?

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলনরত কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। এ সময় পুলিশকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা। গতকাল বাংলামোটরে।  প্রথম আলো
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলনরত কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। এ সময় পুলিশকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা। গতকাল বাংলামোটরে। প্রথম আলো

কয়েক দিনের ব্যবধানে বাংলামোটরের দুটি ভিন্ন চিত্র। প্রথম চিত্রটি ছিল ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের সমাবেশে যোগদানকারী একদল উচ্ছৃঙ্খল যুবক বাসের অপেক্ষায় থাকা এক কলেজছাত্রীকে লাঞ্ছিত করলে সেখানে কর্তব্যরত একজন পুলিশ সদস্য তাঁকে ওই দুর্বৃত্তদের হাত থেকে উদ্ধার করেন। পরে তিনি একটি বাসে মেয়েটিকে তুলে দেন।
আর এর তিন দিন পর ১০ মার্চ একই স্থানে কয়েকজন আন্দোলনকারী নারী পুলিশের হাতে নিগ্রহের শিকার হন। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে তাঁরা রাস্তায় নামেননি। তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে। আরও অনেকের মতো তাঁরাও চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছেন।
প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, চাকরিতে ঢোকার বয়স ৩৫ বছর করার দাবিতে আন্দোলনরত প্রার্থীদের বেশ কয়েকজনকে আটক করেছ পুলিশ। আন্দোলনকারীদের দাবি, তাঁদের অন্তত ২৫ জনকে আটক করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চাকরিতে ঢোকার বয়স ৩৫ করার দাবিতে একদল আন্দোলনকারী সকাল সাড়ে দশটা থেকে শাহবাগ জাদুঘরের সামনে অবস্থান নিতে শুরু করেন। বেলা ১১টার দিকে দুই শতাধিক আন্দোলনকারী সেখানে অবস্থান নেন। প্রায় এক ঘণ্টা তাঁরা সেখানে থেকে ওই দাবিতে স্লোগান দেন। একপর্যায়ে তাঁরা সেখান থেকে বাংলামোটরের দিকে মিছিল নিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। আন্দোলনকারীরা বাধা উপেক্ষা করে মিছিল করতে গেলে পুলিশ তাঁদের লাঠিপেটা করে। এ সময় পুলিশের পিটুনি ঠেকাতে নারী আন্দোলনকারীরা এগিয়ে এলে পুলিশ তাঁদেরও পিটুনি দেয়। আন্দোলনকারীদের দাবি, তাঁদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ হামলা চালিয়ে অন্তত ২৫ জনকে ধরে নিয়ে যায়।
সাধারণ ছাত্র পরিষদের ব্যানারে যেসব আন্দোলনকারী শাহবাগে সমবেত হয়েছিলেন, তাঁরা কেউ উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছেন, সে দাবি পুলিশও করেনি। তাঁরা মিছিল করে বাংলামোটরে গেলে পুলিশ সেখানে তাঁদের বাধা দেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সেটি তারা করতেই পারে। তাই বলে নারী আন্দোলনকারীদের নিয়ে পুলিশের পুরুষ সদস্যরা কেন এভাবে টানাহ্যাঁচড়া করবেন? রোববার প্রথম আলোর রাজধানী পাতার ছবিটির দিকে তাকিয়ে দেখুন। একজন পুলিশ সদস্য টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন আন্দোলনকারীকে। একজন নারী তাঁকে ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। পুলিশ ও পুরুষ আন্দোলনকারীদের টানাটানির মধ্যে পড়ে নারী আন্দোলনকারীর অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পড়ে। আরেকটু হলেই তিনি রাস্তায় পড়ে যেতেন।
আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, পুলিশ সেখানে পুরুষ চাকরিপ্রার্থীদের ধরে নিয়ে যায়। এসব নারী আন্দোলনকারী সামনে এলে পুলিশ তাঁদেরও পিটুনি দেয়। এটি কি ভব্যতা? নারীরা এখন চাকরির জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে মার খাচ্ছেন। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে নিগৃহীত হচ্ছেন। প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলন করতে গিয়ে মার খাচ্ছেন।

নারীদের বাধা দিচ্ছেন পুলিশের সদস্যরা। শাহবাগ, ঢাকা।
নারীদের বাধা দিচ্ছেন পুলিশের সদস্যরা। শাহবাগ, ঢাকা।

সাধারণত কোনো কর্মসূচিকে নারীরা থাকলে তাঁদের সামাল দিতে নারী পুলিশ সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। কিন্তু গতকাল শাহবাগ ও বাংলামোটরে কোনো নারী পুলিশ ছিলেন না। তাঁদের কাজটিই করানো হয়েছে পুরুষ সদস্যদের দিয়ে। এটি সম্পূর্ণ অনৈতিক ও বেআইনি।
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে অনেক নারী সদস্য রয়েছেন। তর্কের খাতিরে যদি আমরা ধরে নিই আন্দোলনকারী নারীরা বাড়াবাড়ি করেছেন, তারপরও সরকারের উচিত ছিল নারী পুলিশদের দিয়ে তাদের সামাল দেওয়া। এই ছবি পত্রিকায়, টিভিতে যখন ওই পুরুষ পুলিশ সদস্যদের স্ত্রী ও মেয়েরা দেখবেন, তাঁরা কী ভাববেন। স্ত্রীরা ভাববেন, তাঁদের স্বামীরা রাস্তায় নারীদের ওপর নিগ্রহ করেন। কন্যারা ভাববেন, তাঁদের বাবারা রাস্তায় নারী নিগ্রহ করেন।
দীর্ঘদিন ধরেই চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে ৩৫ বছর করার দাবিতে সাধারণ ছাত্র পরিষদ আন্দোলন করে আসছে। তাদের দাবি কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। যাঁরা চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছর করার পক্ষে তাঁদের যুক্তি হলো বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করতে ২৭-২৮ বছর চলে যায়। চাকরির বয়সসীমা না বাড়ালে অনেকের পক্ষে আবেদন করা বা প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয় না।
সাধারণ ছাত্রপরিষদ সরকারের কাছে চাকরি দেওয়ার জন্য বাড়তি কোনো সুবিধা চায় না। তারা বলছে না বয়স হয়ে গেছে বলে তাদের জন্য আলাদা কোটাব্যবস্থা রাখা হোক। তারা চায় চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগটুকু। অন্যান্য পরীক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে যদি পরীক্ষায় টিকে যায় চাকরি পাবে, না টিকলে পাবে না। তারপরও সরকার বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে। পৃথিবীর অনেক দেশে যেকোনো বয়সে যেকোনো ব্যক্তি চাকরি নিতে পারেন। আবার অনেক দেশে বয়স বেঁধে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে একসময় চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ বছর ছিল। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তিন বছর বাড়ানো হয়েছে। আগে অবসরের বয়সসীমা ছিল ৫৭ বছর। এখন সেটি ৫৯ করা হয়েছে।
সে ক্ষেত্রে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে পারে। এখানে হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ তরুণের জীবনই শুধু নয়, তাঁদের পরিবার-পরিজনের অস্তিত্বও জড়িত। চাকরি পাওয়ার পথ বন্ধ হলে এই উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা কোথায় যাবেন? আর কত দিন রাস্তায় পুলিশের মার খাবেন?