সাম্প্রদায়িকতার এপার-ওপার

কলকাতার টিভিতে একবার ভারতে মুসলিম নির্যাতন নিয়ে বিজেপি ও সিপিএমের দুই নেতার বিতর্ক দেখেছিলাম। বিজেপি নেতা সিপিএম নেতার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনারা শুধু ভারতে মুসলমান নির্যাতন দেখেন, বাংলাদেশে যে হিন্দু নির্যাতন হচ্ছে, সেটা দেখেন না কেন?’ ভারতের বামপন্থী ও সেক্যুলারদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী বা বিজেপিপন্থীদের এটা একটা প্রবলভাবে প্রচারিত অভিযোগ যে তারা ভারতের মুসলমানদের নিয়েই বেশি চিত্কার করে, ব্যস্ত থাকে, হিন্দুদের স্বার্থ তারা দেখে না। হিন্দুদের স্বার্থের কথা বলে, হিন্দু গৌরব ফিরিয়ে আনার কথা বলেই বিজেপির হিন্দুত্ববাদী কট্টর রাজনীতি দাঁড়িয়েছে। করপোরেট স্বার্থকে ধর্মীয় উন্মাদনার মোড়কে ঢেকে বিজয়যাত্রার কূটকৌশল যে খুবই কার্যকর, তার প্রমাণ সর্বশেষ ত্রিপুরার নির্বাচনে তাদের বিজয়।

একই ঘটনা বাংলাদেশেও। এখানে যখন কেউ হিন্দুসহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বা বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে, তখন তাদের উদ্দেশে ঠিক একই রকম অভিযোগ শোনা যায়। বলা হয়, এরা সেক্যুলার বামপন্থী, এরা এ দেশে শুধু হিন্দুদের নির্যাতন দেখে। ভারতে যে মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে তা এদের চোখে পড়ে না। জাতিগত সংখ্যালঘু নিয়েও একই ধরনের প্রচার। পার্বত্য চট্টগ্রামে কিংবা সমতলের অবাঙালি বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন নিয়ে কথা বললেও এই আওয়াজ ওঠে, এরা বাঙালিদের স্বার্থ দেখছে না। অথচ দুই দেশেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তারাই সোচ্চার, যারা শ্রেণিগত-লিঙ্গীয়-আঞ্চলিক নিপীড়ন বৈষম্য নিয়েও বরাবর সোচ্চার থাকে।

বাংলাদেশে যাঁরা মনে করেন, যেহেতু এ দেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেহেতু এ দেশ ইসলামপন্থী রাজনীতি দ্বারাই পরিচালিত হওয়া উচিত, তাঁদেরই হিন্দু সহচিন্তকেরা মনে করেন ভারতকে অবশ্যই হিন্দু রাষ্ট্র হতে হবে, যেহেতু সেখানে হিন্দুরা প্রধান জনগোষ্ঠী। যে ধর্মের মানুষ কোনো দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই দেশ তাদের ধর্মীয় আইন/নীতি/মতাদর্শ দ্বারাই পরিচালিত হবে-এই অবস্থান গ্রহণ করলে বাংলাদেশ হবে ইসলামি রাষ্ট্র এবং সে অনুযায়ী ভারতে হিন্দুত্ববাদী শাসনের দাবি হবে যুক্তিযুক্ত। একই কারণে ইউরোপে খ্রিষ্টান কট্টরপন্থীদের মুসলিম অভিবাসী নিধন বা বিতাড়ন কর্মসূচিও সমর্থন করতে হবে। এই হিসাবে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের কট্টরপন্থীরা পরস্পরের মহাশত্রু হিসেবে আবির্ভূত হলেও তাঁরা আসলে পরস্পরের সহযোগী, শক্তিদাতা।

উত্তর ভারতের হিন্দু গুরু ও মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা বলে কিছু হতে পারে না।’ একই রকম কথা বাংলাদেশেও অনেক ধর্মীয় নেতা বা সাম্প্রদায়িক তাত্ত্বিকের মুখে শোনা যায়। কিন্তু দিল্লির শাহি মসজিদের ইমাম বলেন, ‘আমরা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখার দাবি জানাই।’ ইউরোপ-আমেরিকার কট্টর শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টানদের বিভিন্ন গোষ্ঠী মুসলমান আর অশ্বেতাঙ্গদের তাড়িয়ে খ্রিষ্টান শ্বেতাঙ্গ শাসন প্রতিষ্ঠায় বিষের রাজনীতি ছড়াচ্ছে। ট্রাম্প এখন এদেরই মুখ। অন্যদিকে ইউরোপ-আমেরিকার মুসলিম বা অন্যান্য জাতি-ধর্মের মানুষ রাষ্ট্রের ধর্ম ও বর্ণনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে দাঁড়াচ্ছে, এ ছাড়া তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়। তাদের পাশে যাঁরা দাঁড়ান, তাঁদেরও ‘সেক্যুলার বামপন্থী’ বলে তিরস্কার করে সন্ত্রাসীরা।

কোনো দেশে বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাই যদি প্রধান থাকে, তাহলে শ্রেণিগত লিঙ্গীয় বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি ও ধর্মের মানুষও। কিন্তু যারা সংখ্যালঘু, তারা এসব সমস্যার মধ্যে তো থাকেই, নিজেদের জাতিগত পরিচয়ের কারণে তারা বাড়তি চাপের শিকার হয়। ভারতের গুজরাটে যে নৃশংস হত্যা ও নির্যাতন হয়েছিল, তা সেখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপরই হয়েছিল। এখনো অনেক জায়গায় মুসলমান পরিচয়ের কারণে নির্যাতন চলছে। সাম্প্রতিক কালে গরু জবাইকে কেন্দ্র করেও মুসলমান ও দলিত সমাজের ওপর হয়রানি ও নির্যাতন হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে হিন্দু ও বৌদ্ধদের মন্দির, প্রতিমা ও ঘরবাড়িতে যেসব হামলা হয়েছে, সেগুলোতে ধর্মীয় পরিচয়কেই প্রধান করে হিংস্র উন্মাদনা তৈরি করেছে জমি-সম্পদ দখল ও লুণ্ঠনকারীরা। দুই দেশেই সংখ্যাগুরু ধর্মের আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ এর বিরুদ্ধে অনেক সোচ্চার। কিন্তু তাদেরও আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে দুই দেশেই।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা বেড়েছে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকারি প্রশাসনের ভূমিকা এবং ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া খুব তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। রামু থেকে শুরু করে গত কয়েক বছরের সাম্প্রদায়িক হামলার বিষয়ে সরকারি প্রশাসনের নির্লিপ্ততা, অপরাধীদের শনাক্ত করার ব্যাপারে দীর্ঘসূত্রতা প্রায় একই রকম। অন্যদিকে বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী নিয়ে ভারতের বর্তমান সরকার যে রকম ভূমিকা নিয়েছে, এর আগে সে দেশের অন্যান্য সরকারের চাইতে তা ভিন্ন। মোদি সরকার ঘোষণা দিয়েছে, ‘বাংলাদেশ থেকে কোনো হিন্দু যদি ভারতে আশ্রয় চান, সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে।’

বাংলাদেশে কোথাও সাম্প্রদায়িক হামলা হলে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়ায় কারও মনে হতে পারে যে বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দুদের পাশে দাঁড়াচ্ছে ভারতের সরকার, দূতাবাস। কিন্তু কার্যত তাদের ভূমিকা এ দেশে হিন্দু পরিচয়ের মানুষদের রীতিমতো অপমানিত করে, তাদের নিরাপত্তাহীনতাও বাড়ায়। এতে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান তো হয়ই না, বরং এ দেশে যারা সারাক্ষণ দাবি করে ‘হিন্দুরা ভারতের লোক’, তাদের গলার জোর বাড়ে। ভারতের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরাই বলেন, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন ভারতের বিজেপি সরকারের সে দেশে রাজনৈতিক ফায়দা ওঠাতে সাহায্য করে বলেই এ নিয়ে তাদের এত উৎসাহ। তার মানে, বাংলাদেশে যারা ইসলামের নামে মন্দির বা হিন্দুবাড়িতে হামলা করছে, তারা প্রকারান্তরে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকেই সহায়তা করছে, ভারতের মুসলমানদের অবস্থা আরও নাজুক করছে।

প্রকৃতির মতো বৈচিত্র্যের মধ্যেই মানুষের সৌন্দর্য ও শক্তি। একদিকে পুঁজির বিশ্বায়ন, সর্বশেষ প্রযুক্তি নিয়ে উন্নয়নের জয়গান, অন্যদিকে যেন নিজেকে ছোট করতে করতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে যাওয়ার পথে মানুষের যাত্রা। অন্যের প্রতি বিদ্বেষের বিষ শুধু যে অন্যকে বিষাক্ত করে তা নয়, তা নিজেকেও বিষে জর্জরিত করে। অজান্তেই অনেক পরিবারে অন্য ধর্ম, জাতি, ভাষা, অঞ্চল, সংস্কৃতির মানুষ সম্পর্কে অশ্রদ্ধা-বিদ্বেষ তৈরি করা হয়, যার ফলে শৈশবেই বিষ ঢুকে যায়। এই বিষে আক্রান্ত হয় অন্য শিশুরাও। এগুলোই ডালপালা মেলে। সমাজে এগুলো টিকে থাকলে এর ওপর ভর করেই প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ-বর্ণান্ধ রাজনীতি, দখল-লুণ্ঠনের অর্থনীতি বেড়ে ওঠে। যারা এর সুবিধাভোগী, তারাই এই বিদ্বেষ চাষে তৎপর থাকে।

আনু মুহাম্মদ: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
[email protected]