হকিংয়ের দুনিয়ায় শুধু বিজ্ঞান ছিল না

মৃদু হাসছেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। ১২ আগস্ট ২০০৯, হোয়াইট হাউসে।  ছবি: নাসির আলী মামুন
মৃদু হাসছেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। ১২ আগস্ট ২০০৯, হোয়াইট হাউসে। ছবি: নাসির আলী মামুন

তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার খটমটে দুনিয়ায় এ যুগের রাজা ছিলেন স্টিফেন হকিং। ছিলেন বলতে হচ্ছে, কারণ তিনি এখন আর নেই। এই যে নেই, এই না থাকাটা কেমন? বিশেষত স্থান ও কালের বিস্ময়কর দুনিয়ায় তাঁর এই ‘নেই’ হওয়াটা ঠিক কেমন? হকিং থাকলে এই নিয়েও হয়তো রসিকতা করতেন। দিতেন বুদ্ধিদীপ্ত কোনো উত্তর। মৃত্যু নিয়ে প্রশ্নের উত্তর যে একেবারে দেননি তা নয়।

মৃত্যু সম্পর্কিত তাঁর মতটি ছিল সোজাসাপ্টা। তাঁর ভাষায়, ‘মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। মরার জন্য আমার কোনো তাড়াহুড়াও নেই। তার আগেই বহু কিছু করার আছে আমার। আমার কাছে মস্তিষ্ক হচ্ছে কম্পিউটারের মতো, যার সরঞ্জামগুলো নষ্ট হলেই সে আর কাজ করবে না। আর একটি নষ্ট কম্পিউটারের জন্য কোনো স্বর্গ বা নরক অপেক্ষায় থাকে না। অন্ধকারে ভয় পাওয়া মানুষের জন্য নির্মিত এক কাল্পনিক গল্প এটি।’

বলার অপেক্ষা রাখে না যে ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইয়ে এ ধরনের বক্তব্য তুলে ধরার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল হকিংকে। বইটিতে তিনি সরাসরি বলেন, ‘মহাবিশ্বকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই।’

হকিংয়ের বিদায়ে তাঁর সহকর্মীদের দেওয়া শোকবার্তায় শুধু তাঁর বিজ্ঞানী সত্তাটিই উঠে আসেনি, সেখানে তাঁর রসবোধ, প্রাণময় উপস্থিতি থেকে শুরু করে বহু কিছুই উঠে এসেছে। তাঁদের কাছে হকিংয়ের অনুমান, উদ্ভট কর্মকাণ্ড, রসাত্মক বিভিন্ন মন্তব্য—এসবই তাঁর দেওয়া তত্ত্বের মতোই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে আজ একটি যতি পড়ে গেল। টুইটারে হকিংভক্তদের শোকবার্তায়ও এই দিকই উঠে এসেছে। অনেকেই তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার অগ্রগতিতে তাঁর অবদানের সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করছেন তাঁর রসবোধকেও।

হকিংয়ের রসবোধের কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ২০০৯ সালের ২৮ জুন হকিং কালভ্রমণকারীদের (যাঁরা মনে করেন অতীত ও ভবিষ্যতে ভ্রমণ করা সম্ভব) সম্মানে একটি পার্টি দিলেন। কিন্তু কেউ এল না। কারণ, এই আয়োজনে যোগ দিতে অতিথিদের কাছে আমন্ত্রণপত্রই পাঠানো হয়নি। ওই আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয় পরদিন, অর্থাৎ ২৯ জুন। সবাই হতবাক। আর হকিংয়ের সোল্লাস ব্যাখ্যা, ‘কালভ্রমণ অসম্ভব। এরই পরীক্ষামূলক প্রমাণ এটি।’
২০১০ সালে ‘মাই ব্রিফ হিস্ট্রি’ শীর্ষক এক লেকচারে নিজের স্কুলজীবন নিয়ে হকিংয়ের বক্তব্য, ‘দারুণ সব মেধাবী ছিল আমার সহপাঠী। আর আমি ছিলাম ভীষণ বিশৃঙ্খল। আমার হাতের লেখা শিক্ষকদের হতাশার কারণ ছিল। অথচ আমার সহপাঠীরা আমাকে দিল আইনস্টাইন উপাধি। অবস্থা এমন ছিল যে ১২ বছর বয়সে আমার দুই বন্ধু নিজেদের মধ্যে বাজি লাগল। বাজির বিষয় “জীবনে আমি কিছু করতে পারব কি না”। যে জিতবে সে পাবে এক ব্যাগ মিষ্টি। জানি না এই বাজির কোনো মীমাংসা হয়েছে কি না, হলে তা কী।’

বাজি অবশ্য স্টিফেন হকিংও কম খেলেননি। তবে জেতার ভাগ্য খারাপ ছিল তাঁর। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়মিত বাজি ধরতেন তিনি। ১৯৭৫ সালে মার্কিন পদার্থবিদ কিপ থ্রোনের সঙ্গে হকিং বাজি ধরেন যে মহাজাগতিক এক্স-রের উৎস সিগনাস এক্স-১, কোনো কৃষ্ণগহ্বর নয়। ১৯৯০ সালে বাজিতে হেরে গিয়ে থ্রোনকে অ্যাডাল্ট ম্যাগাজিন ‘পেন্টহাউস’-এর গ্রাহক হওয়ার পয়সা দেন। ১৯৯৭ সালে তিনি ও থ্রোন বাজি ধরেন আরেক পদার্থবিদ জন প্রেসকিলের সঙ্গে। বিষয়, কৃষ্ণগহ্বরে তথ্যও হারিয়ে যাবে। ২০০৪ সালে ভুল স্বীকার করে বাজির শর্তমতো বিশ্বকোষ তুলে দেন তাঁরা প্রেসকিলের হাতে। আর ২০১২ সালে হকিং গর্ডন কেনের কাছে বাজি ধরে ১০০ ডলার হারেন। এবারে বাজির বিষয় ছিল ‘হিগস-বোসন’ কণার আবিষ্কার সম্ভব হবে না।

আবিষ্কার নিয়ে স্টিফেন হকিংয়ের মন্তব্যটিও স্মরণযোগ্য। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মাহেন্দ্রক্ষণটি ঠিক কেমন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘এটি সঙ্গমের মতো নয়। তবে স্থায়িত্ব বেশি।’ এমন বহু সরস মন্তব্য রয়েছে হকিংয়ের। আবার পৃথিবীর ইতিহাস নিয়েও সচেতন ছিলেন তিনি। ভিনগ্রহের প্রাণী নিয়ে তাঁর মন্তব্যটিই এর প্রমাণ।

সবাই যখন ভিনগ্রহের প্রাণী বা এলিয়েন নিয়ে বেশ রোমাঞ্চে ভুগছে, তখন হকিং সতর্ক করছেন। ২০১০ সালে ‘ইনটু দ্য ইউনিভার্স উইথ স্টিফেন হকিং’ শীর্ষক এক লেকচারে তিনি বলেন, ‘এলিয়েনদের আগমন কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে, যেমনটি হয়েছিল আদিবাসী আমেরিকানদের ক্ষেত্রে। আমাদের নিজেদের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। মানুষের বিচার করা উচিত যে তারা ঠিক কতটা বুদ্ধিমান সত্তার সঙ্গে সাক্ষাতে প্রস্তুত রয়েছে।’

শুধু ইতিহাস-সচেতনই ছিলেন না, নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও ভোলেননি স্টিফেন হকিং। ২০১৩ সালে ফিলিস্তিনের শিক্ষাবিদদের আহ্বানে হকিং ইসরায়েলে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের একটি বড় সম্মেলন বয়কট করেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান মনোনয়ন পাওয়ার পর ব্যাপক শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ট্রাম্পের মস্তিষ্কই শঙ্কার কারণ হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। এই শঙ্কা যে অমূলক ছিল না, তা এখন দৃশ্যমান।

স্টিফেন হকিং বরাবরই নিয়তি বা ভাগ্যের পরিবর্তে বিবেচনাবোধ ও কাজের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। নিয়তি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যটিও বেশ সুস্পষ্ট। ‘ব্ল্যাক হোলস অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স অ্যান্ড আদার এসেস’-এ তিনি লিখেছেন, ‘আমি দেখেছি যে এমনকি যেসব মানুষ মনে করে সবই পূর্বনির্ধারিত এবং মানুষের কিছুই করার নেই, তারাও রাস্তার পার হওয়ার সময় আশপাশটা ভালো করে দেখে নেয়।’

মাত্র ২১ বছর বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধি মোটর নিউরনে আক্রান্ত হয়েও স্টিফেন হকিং কখনো বিরত হননি গবেষণা থেকে। পদার্থবিদ্যায় নতুন নতুন অগ্রগতিতে জোরালো অবদান রাখেন তিনি। আর এটি সম্ভব হয়েছিল নিয়তির মতো বিষয়গুলোকে অস্বীকার করে কর্মযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কারণে। মানুষের অভীষ্ট অর্জনে এই বিষয়কেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।

এবিসি নিউজের ডিয়ান সয়ারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্দেশে স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, ‘নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে তাকাও, পায়ের দিকে নয়। কাজ থেকে বিরত থাকবে না। কারণ, কাজই জীবনকে অর্থবহ করে। এটি ছাড়া জীবন শূন্য। আর ভালোবাসা পাওয়ার মতো সৌভাগ্যবান হলে তাকে কখনো পায়ে দোলো না।’