চীনের উদাহরণ কর্তৃত্ববাদ ছড়াবে

চীনের শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে সি চিন পিংয়ের ক্ষমতার মেয়াদ আজীবন করার ব্যবস্থা হয়েছে
চীনের শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে সি চিন পিংয়ের ক্ষমতার মেয়াদ আজীবন করার ব্যবস্থা হয়েছে

চীনের শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ক্ষমতার মেয়াদ আজীবন করার ব্যবস্থা হয়েছে। ইতিপূর্বে দেশটির শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত ছিল প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট দুই দফার বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি শাসনতন্ত্র থেকে এই ধারা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর চীনের পার্লামেন্টে গত রোববার প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে পাস হয়েছে। এর ফলে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ক্ষমতাকাল আমৃত্যু সম্প্রসারিত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
মাও সে তুংয়ের পর কমিউনিস্ট চীনে সির মতো ক্ষমতাশালী নেতার আবির্ভাব ঘটেনি। মাওয়ের মৃত্যুর পর দেং শিয়াও-পিংয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট নেতাদের অধীনে একটি সম্মিলিত নেতৃত্ব ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান গ্রহণ করে। দেং দেশের ‘সর্বপ্রধান নেতা’ হিসেবে স্বীকৃত হলেও তাঁরই নির্দেশে ১৯৮২ সালে শাসনতন্ত্র সংশোধন করে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের জন্য সর্বোচ্চ দুই দফার শাসনকাল নির্ধারিত হয়। দেংয়ের আগে দেশের প্রধান (বস্তুত একমাত্র) নেতা ছিলেন মাও, যিনি ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত একটানা ক্ষমতায় ছিলেন। মাওয়ের মৃত্যুর পর চীনে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের পেছনে দেংয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য, কিন্তু শাসনতন্ত্র পরিবর্তনের পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য গণতন্ত্রায়ণ ছিল না। তিনি শুধু চেয়েছিলেন মাওয়ের মতো কোনো একনায়ক যেন আমৃত্যু ক্ষমতা আঁকড়ে না থাকতে পারেন। কিন্তু এখন সেই বিষয়টিই আবার ফিরে এল। 

এক দল ও এক ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার মাধ্যমে একক কর্তৃত্ববাদী শাসনের দৃষ্টান্ত অনেক। নামে গণতান্ত্রিক অনেক দেশে বস্তুত এক ব্যক্তি ও এক দলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর সেরা উদাহরণ রাশিয়ার পুতিন, তুরস্কের এরদোয়ান, সিরিয়ার বাশার ও মিসরের সিসি। ফিলিপাইনের দুতার্তে, মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানও এই তালিকায় পড়েন। অনেকে ভারতের মোদি, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প ও হাঙ্গেরির আরবানের মধ্যেও এই একনায়কসুলভ মনোভাব লক্ষ করেছেন।
বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী শাসনের এই যে প্রবণতা, সেই বিপদ বাংলাদেশের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক?
এমন প্রশ্ন নিয়ে আমি বেশ কয়েকজন মার্কিন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা প্রায় সবাই মনে করেন, এমন সম্ভাবনা অবাস্তব নয়। যেমন ওয়াশিংটনের উইড্রো উইলসন সেন্টারের বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে কোনো একটি দলের একক শাসন প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হতে পারে। দেশে কোনো কার্যকর বিরোধী শক্তি না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীন দলের যেকোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং দলীয় প্রধানের অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্ষমতায় টিকে থাকার পরিস্থিতি তৈরি হবে।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে ভাবা হয়েছিল যে স্বেচ্ছাচারের দিন শেষ, গণতন্ত্রের দিন এসে গেছে। ধনতন্ত্রের বিজয়ের সঙ্গে যুক্ত করে এই গণতান্ত্রিকতাকে ফুকুইয়ামা ‘অ্যান্ড অব হিস্ট্রি’ বলে রায় দিয়ে বসেছিলেন সেই ১৯৮৯ সালে। গণতন্ত্রের এই বিজয়ের জন্য বিশ্বকে ৩০০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। অথচ ৩০ বছরও লাগল না সেই অবস্থা বদলে যেতে। ফ্রিডম হাউস ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বলেছে, হায় হায়, সব গেল। ‘সিকি শতাব্দী আগে ভাবা হয়েছিল স্বেচ্ছাচারী শাসনের অবসান হয়েছে, উদারনৈতিক গণতন্ত্র জয়লাভ করেছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, গণতন্ত্র বনাম স্বেচ্ছাচার-এ দুই আদর্শিক দ্বন্দ্বে জয়লাভের বদলে আজ গণতন্ত্রই “ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্বল” হয়ে পড়ছে।’
ফ্রিডম হাউসের কথামতো, ২০১৭ সাল ছিল সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়। ‘মুক্ত ও স্বচ্ছ নির্বাচন, সংখ্যালঘুর অধিকার, মুক্ত তথ্যব্যবস্থা ও আইনের শাসন-গণতন্ত্রের এই চার খুঁটির প্রতিটিই ১৯১৭ সালে বিশ্বের সর্বত্র আক্রমণের শিকার হয়।’ গত বছর বিশ্বের ৭১টি দেশে রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অবনতি ঘটে। অগ্রগতি হয়েছে এমন দেশের সংখ্যা মাত্র ৩৫। ফ্রিডম হাউস জানাচ্ছে, ২০১৭ সাল ধরে গত ১২ বছরে গণতন্ত্র ক্রমাগত পিছু হটেছে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়।
ফ্রিডম হাউসের তথ্য অনুসারে, আজকের বাংলাদেশ ‘আংশিক মুক্ত’। ১০০ যদি মুক্ত গণতান্ত্রিক অবস্থা হয়, তাহলে বাংলাদেশের নম্বর মাত্র ৪৭। রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা-এই উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ‘আংশিক মুক্ত’। তথ্য স্বাধীনতার ক্ষেত্রে, এই থিংক ট্যাংকের মতে, অবস্থা আরও খারাপ, সেখানে তার অবস্থান ‘নট ফ্রি’।
কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ বুকের রক্ত ঢেলেই তো সামরিক ও আধা সামরিক শাসনের স্বেচ্ছাচারিতার লৌহকামড় থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। তাহলে গণতন্ত্রের সেই কোমল আলিঙ্গন কীভাবে ছিন্ন হলো? আর তা এখনই বা হতে হলো কেন?
নিউইয়র্কার পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট কূটনীতিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রিচার্ড হাস এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এভাবে, ‘যেসব দেশ পিছু হেঁটেছে, তার প্রতিটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বেকারত্ব ও সম্পদের সমবণ্টন প্রশ্নে লক্ষণীয় সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। সংকট থেকে উত্তরণ ঘটবে-এই আশায় এসব দেশের মানুষ স্বেচ্ছাচারী একনায়কতন্ত্র মেনে নিতে রাজি হয়েছে। সেটা একটা কারণ। অন্য বড় কারণ, এসব দেশে অনুদার ব্যবহার ও রাজনৈতিক নিপীড়নের জন্য নেতাদের বড় কোনো রাজনৈতিক মূল্য দিতে হয় বলে মনে হয় না। এ রকম ব্যবহার করলে শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, বাধা দেবে বা তাঁদের লজ্জা দেবে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য নেতা বা দল নেই। ফলে এসব শাসকের ভীত হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই।’
চীনে ঠিক এ ঘটনাই ঘটেছে। সীমিত আকারে হলেও সে দেশের একটি বড় অংশ বস্তুগত অর্থে আগের তুলনায় নিজেদের অধিক অধিকারভোগী মনে করে। রাস্তাঘাট চকচকে হয়েছে, ঘরে টিভি এসেছে, কারও কারও গাড়িও। হোক না রাজনৈতিক নিপীড়ন, হোক না দুর্নীতি, হাতে নগদ তো কিছু মিলছে!
বাংলাদেশের অবস্থাও বোধ হয় ভিন্ন কিছু নয়। একক কোনো দলের কর্তৃত্ব ও সেই ধারার রাজনীতির যে লক্ষণ বাংলাদেশে ক্রমশ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে শাসক দল-সেটা যে দলই হোক না কেন-নিজের সুবিধার্থে এমন একটি ন্যারেটিভ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে তারা ছাড়া বাকি সবাই রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ন্যারেটিভের চরিত্র আদর্শগত বা আইডিওলজিক্যাল। এখানে ধর্ম, জাতীয়তাবাদ বা মুক্তিযুদ্ধই মুখ্য। এই ন্যারেটিভের প্রতিবাদ করুন, অমনি আপনি জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী বলে পরিগণিত হবেন। রিচার্ড হাস ঠিকই ধরেছেন, নাগরিক অধিকার সংকুচিত হয়ে আসছে জেনেও দেশের অধিকারভোগীদের বড় একটি অংশ হয় স্বেচ্ছায় এই ন্যারেটিভ সমর্থন করে, অথবা নগদ লাভ আছে জেনে নৈতিক আপত্তি সত্ত্বেও তারা মুখ বুজে থাকে। কোনো কার্যকর নাগরিক অধিকার আন্দোলন (যাকে আমরা বাংলাদেশে সুশীল সমাজ বলে থাকি) না থাকায় কোনো দৃশ্যমান-শ্রুতমান প্রতিবাদও নেই।
চীনের উদাহরণে আরেকবার ফিরে যাই। নাগরিক স্বার্থ ও দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতার নামে সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতার সমাহরণের শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতি আদায় করে নেওয়া হচ্ছে। একদিকে একজনের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয়, বিশেষত নাগরিক অধিকার রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তবে এ সবই সম্ভব হচ্ছে একমাত্র এ কারণে, যিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে, তাঁর রয়েছে জাদুকরি ক্ষমতা, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ক্যারিশমা’। ইতিহাসের প্রত্যেক একনায়ক তাঁদের সমর্থকদের কাছে ক্যারিশম্যাটিক, যেমন ছিলেন মাও, স্তালিন অথবা আছেন তুরস্কের এরদোয়ান। সি চিন পিংকেও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আমরা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ভিত্তিতে একটি উদারনৈতিক বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান দেখেছি। এই ব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিল জাতিসংঘ এবং জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি নীতিভিত্তিক রাজনৈতিক ‘কোড’। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিজয়ী যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ এই ব্যবস্থাকে শক্ত সমর্থন দিয়েছিল। আজ যে সেই ব্যবস্থা হেলে পড়ছে, তার একটি বড় কারণ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই একনায়কতান্ত্রিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। পশ্চিম ইউরোপের একটি বড় অংশেও সেই একই লক্ষণ চাঙা হচ্ছে।
সি চিন পিং যদি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টায় সফল হন, তাহলে বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই প্রবণতা আরও বাড়বে, প্রসারিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ তখন এর বাইরে থাকবে বলে মনে হয় না।
হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি