আবার পুতিন: গণতন্ত্র কত দূরে?

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

আগামীকাল রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, কিন্তু রুশ পত্রপত্রিকার অনলাইন সংস্করণগুলোতে এ নিয়ে কোনো চাঞ্চল্য নেই। সবাই নিশ্চিত, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনই আবার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হতে চলেছেন। জনমত জরিপগুলোও তা-ই বলছে। শুধু রাশিয়ায় নয়, পশ্চিমা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমেও বলা হচ্ছে, কোনো সন্দেহ নেই যে পুতিনই আবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হচ্ছেন। 

তা যদি হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে এটা হবে পুতিনের চতুর্থ মেয়াদ। তিনি প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ২০০০ সালে। তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের মেয়াদ ছিল চার বছরের। প্রথম মেয়াদ শেষে ২০০৪ সালের নির্বাচনে তিনি আবার প্রেসিডেন্ট হন। রাশিয়ার সংবিধানের নিয়ম হলো, কোনো ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। অর্থাৎ ২০০৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হলে পুতিনের আর প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু তখন তাঁর বয়স মাত্র ৫৬, স্বাস্থ্য খুব ভালো এবং রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রায় সীমাহীন। তাঁর দেশে জার সম্রাটেরা শাসন করতেন আমৃত্যু। সোভিয়েত আমলে ইয়োসেফ স্তালিন শাসন করেছেন টানা ৩০ বছর, লিওনিদ ব্রেঝনেভ ১৮ বছর-উভয়েই মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। সেই দেশের সন্তান পুতিন মাত্র আট বছর শাসন করেই অবসরে চলে যাবেন, এটা হয় না।

কিন্তু এখন জারতন্ত্র নেই, সোভিয়েততন্ত্রও ইতিহাসে বিলীন। এখন ‘গণতন্ত্র’ এবং তা চলে সংবিধানের বাঁধা নিয়মে। পুতিন এক কায়দা করলেন: দমিত্রি মেদভিয়েদেভ নামে ৪৩ বছর বয়স্ক এক যুবককে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড় করিয়ে দিলেন। রুশ জনগণ পুতিনে এতই মুগ্ধ যে তাঁর মনোনীত ‘কলাগাছ’কেই তারা তাদের প্রেসিডেন্ট বানাল। আর স্বয়ং পুতিন হলেন মেদভিয়েদেভের মন্ত্রিসভার প্রধান: প্রিমিয়ের মিনিস্তের।

রুশ গণতন্ত্রের এই নাটক চলল চার বছর। ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় এগিয়ে এল। এবার আর পুতিনের প্রার্থী হওয়ার পথে কোনো সাংবিধানিক বাধা নেই। কারণ, সংবিধানে বলা হয়েছে, পরপর দুইবারের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট পদের জন্য দাঁড়াতে পারবেন না; কিন্তু মাঝখানে বিরতি দিয়ে আবার দাঁড়ানোতে কোনো বাধা নেই। সুতরাং পুতিন আবার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হলেন; শতভাগ নিশ্চিত যে আবারও হতে যাচ্ছেন ক্রেমলিনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। কিন্তু তার আগে একটা বড় কাজ তিনি করিয়ে নিলেন: সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চার বছর থেকে বাড়িয়ে করা হলো ছয় বছর। দুই মেয়াদে টানা ১২ বছর রাশিয়া শাসন করবেন, এই তাঁর অভিলাষ।

আগামীকালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেটাই ঘটতে চলেছে। ভোটযুদ্ধে পুতিনের কাছাকাছি যেতে পারে, এমন কেউ নেই। যে একমাত্র ব্যক্তির জনপ্রিয়তা পুতিনকে শঙ্কিত করে বলে শোনা যায়, সেই ব্লগার থেকে রাজনীতিক হয়ে ওঠা ৪২ বছর বয়সী যুবক আলেক্সেই নাভালনিকে এক প্রতারণার মামলায় দণ্ড দিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। নাভালনি জনপ্রিয় হয়েছেন, বিশেষত যুবসমাজের মধ্যে, পুতিন সরকারের রাজনৈতিক মিথ্যাচার ও দুর্নীতি-লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রবল প্রচারণা চালিয়ে। তাঁর একটা স্লোগান হলো: ‘আমরা মিথ্যা বলি না, আমরা চুরি করি না।’ তিনি ও তাঁর অনুসারীরা পুতিন ও তাঁর দলবলকে প্রকাশ্যে অভিহিত করেন মিথ্যুক ও চোর বলে। বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ।

মস্কো ও অন্যান্য শহরে তাঁরা প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁদের ঘনিষ্ঠ লোকজনের চুরি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের মিছিল-সমাবেশ করেছেন। ২০১৩ সালে মস্কোর মেয়র নির্বাচনে নাভালনি ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পেলে অবশ্য পুতিনের সঙ্গে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো না, তবে বিস্তর ভোটের ব্যবধানে হলেও তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতে পারতেন বলে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে কোনো কোনো ভাষ্যকার ধারণা প্রকাশ করেছেন।

যা-ই হোক, নাভালনি ভোটযুদ্ধে নেই, কিন্তু যাঁরা আছেন, তাঁদের অবস্থা আরও খারাপ। পুতিনের মোট সাতজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে যাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছে, তিনি রুশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী ৫৮ বছর বয়সী পাভেল গ্রুদিনিন। এই দলের প্রধান নেতা গেন্নাদি জুগানোভ সোভিয়েত আমলের কমিউনিস্ট, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরও কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়েননি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি নিজে না দাঁড়িয়ে পাভেল গ্রুদিনিনকে দাঁড় করিয়েছেন কেন, এ নিয়ে রুশ সমাজে নানা রকমের কথা আছে। গ্রুদিনিন একজন বিরাট ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা, মাল্টিবিলিয়নিয়ার। একসময় তিনি পুতিনের দল ‘ইউনাইটেড রাশিয়া’তে ছিলেন। বিরাট ‘বুর্জোয়া’ এই লোককে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী করা নিয়ে রুশ পত্রপত্রিকায় হাস্যরসাত্মক কথাবার্তা লেখা হয়েছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থার পরিচালিত জনমত জরিপে বলা হচ্ছে, গ্রুদিনিন ৮ শতাংশের বেশি ভোট পাবেন না।

ভোটযুদ্ধে তিন নম্বরে যাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছে, তিনি ৭১ বছর ভ্লাদিমির ঝিরিনোভস্কি। অতি উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদী এই লোক প্রবল পাশ্চাত্যবিদ্বেষী কথাবার্তা বলেন, লাইভ টেলিভশন টক শোতে মারামারি করার রেকর্ডও তাঁর আছে। তাঁর রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা অনেকটা পুতিনের মতোই, তবে কয়েক গুণ বেশি উগ্র। রাশিয়ায় তাঁকে সমর্থন করার মতো মানুষ কিছু আছে। তিনি ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। এই কয়েক বছরে তাঁর জনপ্রিয়তা একটু কমেছে বলে ধারণা করা হয়। রাশিয়া টুডের জনমত জরিপে বলা হয়েছে, এবারের নির্বাচনে তিনি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেতে পারেন।

ঝিরিনোভস্কির পর যাঁর নাম শোনা যাচ্ছে, তিনি একজন সাংবাদিক, একসময় টিভি উপস্থাপক হিসেবে নাম কুড়িয়েছিলেন: ৩৭ বছর বয়সী ক্সেনিয়া সাবচাক। এই নারীর আরেক পরিচয় হলো তিনি ৯০ দশকের লেনিনগ্রাদের মেয়র আনাতোলি সাবচাকের মেয়ে। পাশ্চাত্যের সংবাদমাধ্যমে তাঁর বেশ সমাদর। কারণ, তাদের মতে অতি উদারপন্থী; তিনি মনে করেন, ক্রিমিয়া ইউক্রেনের ভূখণ্ড, পুতিন অন্যায়ভাবে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ক্সেনিয়া রাশিয়ায় সমকামীদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেন। এই সমস্ত কথা বলে রাশিয়ায় ভোট পাওয়া খুব কঠিন। জনমত জরিপগুলো বলছে, তিনি ২ শতাংশের বেশি ভোট পাবেন না।

পুতিনের অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের অবস্থা এতই খারাপ যে তাঁদের সম্পর্কে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। যে তিন প্রার্থীর কথা বলা হলো, তাঁদেরও সম্মিলিত ভোট ১৬ শতাংশের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায় আগামীকালের নির্বাচন নিয়ে রুশ জনগণের মধ্যে উৎসাহের কেন এত অভাব। আশঙ্কা করা হচ্ছিল, এবার ভোটার উপস্থিতি বেশ কম হবে। পুতিনের নির্বাচনী প্রচারাভিযান ‘প্রাণহীন’; প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে না বলে কোথাও কোনো উত্তেজনা নেই।

তবে শেষ মুহূর্তে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে: উত্তেজনাটা এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে। সের্গেই স্ক্রিপাল নামের সাবেক এক রুশ গুপ্তচর ও তাঁর মেয়েকে বিষ প্রয়োগের অভিযোগে যুক্তরাজ্য সে দেশ থেকে ২৩ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। এই ঘটনায় রাশিয়াজুড়ে জাতীয়তাবাদী আবেগ জেগে উঠেছে। পুতিন ও তাঁর দলবল সেই আবেগ আরও উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। রুশ পত্রপত্রিকার অনলাইন সংস্করণগুলোতে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। এমন একটা আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে যে রাশিয়া আক্রান্ত। প্রাভদা ডট রু সংবাদ শিরোনাম করেছে: রাশিয়া যুদ্ধের কিনারায়।

এমনিতে রাশিয়ার জনগণের বৃহত্তর অংশ মনে করে, গোটা পৃথিবী তাদের শত্রু; আমেরিকা ও ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলো চারদিক থেকে তাদের ঘিরে রেখেছে। এটাই ভ্লাদিমির পুতিনের বিপুল জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। অধিকাংশ রুশি মনে করে, এই বৈরী পৃথিবীতে রাশিয়াকে টিকে থাকতে হলে পুতিনের মতো একজন শক্তিমান নেতা প্রয়োজন, হোন তিনি একনায়ক। পুতিন বলেন, ‘সবকিছুর আগে রাশিয়া।’ সম্প্রতি তিনি বলেছেন, আক্রান্ত হলে তিনি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতেও দ্বিধা করবেন না। বলেছেন, ‘সেই পৃথিবী থেকে কী লাভ, যে পৃথিবীতে রাশিয়া থাকবে না?’

কিন্তু এটা রুশ জনগণের জন্য তো বটেই, বিশ্ববাসীর জন্যও দুঃখের বিষয় যে রাশিয়ার এই ভয়ের কারণে দেশটিতে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারছে না। রাশিয়ায় যেন সব সময় একটা জরুরি পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যখন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য একজন জবরদস্ত জার সম্রাটের বিকল্প থাকে না বলে সে দেশের মানুষের মনে হয়।

মশিউল আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
mashiul. alam@gmail. com