আমরা করব জয়, কিন্তু কবে?

১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শহরে শহরে দাঙ্গা বেধে গিয়েছিল। লস অ্যাঞ্জেলেসের ওয়াটস শহরে আকস্মিক সহিংসতার পর টানা দুই বছর নিউ জার্সির নিয়ার্ক থেকে মধ্য পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর ডেট্রয়েট ও মিনেপোলিস পর্যন্ত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন ইলিনয়ের গভর্নর ওটো কারনারের নেতৃত্বে একটি কমিশন নিয়োগ করেছিলেন। দাঙ্গার কারণ তদন্ত করে দেখা এবং করণীয় ঠিক করার দায়িত্ব দেওয়া হয় সেই কমিশনকে। 

আজ থেকে ৫০ বছর আগে ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিশন অন সিভিল ডিসঅর্ডারস (যেটি ‘কারনার কমিশন’ নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত) যে প্রতিবেদন দাখিল করে তাতে আমেরিকার তৎকালীন আর্থসামাজিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়, যা ওই বিশৃঙ্খলাকে উসকে দিয়েছিল।
কারনার কমিশনের বর্ণনায় এমন এক আমেরিকার চিত্র উঠে এসেছিল, যেখানে আফ্রিকান-আমেরিকান নাগরিকেরা পরিকল্পিত বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল; পর্যাপ্ত আবাসন ও শিক্ষাসুবিধা পাচ্ছিল না এবং আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। তাদের সামনে ‘আমেরিকান ড্রিম’ বলে কিছু ছিল না। ওই কমিশনের মতে, দাঙ্গার মূল কারণ ছিল ‘কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদী আচরণ’। কমিশন বলেছিল, ‘বর্ণ প্রথা আমাদের ইতিহাসের কাঠামো নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং এখন এটি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
এরপরের অর্ধশতাব্দীতে কতখানি অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে তা নির্ণয় করার জন্য এইজেনআওয়ার ফাউন্ডেশন-এর হয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, আমি সেই দলের একজন ছিলাম। কারনার কমিশনের রিপোর্টের একটি বিখ্যাত লাইন ছিল, ‘আমাদের দেশ বিভক্ত ও সমতাহীন দুটি সমাজের দিকে যাচ্ছে, একটি সাদা অপরটি কালো’। দুঃখের বিষয়, আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে কারনার কমিশনের এই কথার সত্যতা এখনো বর্তমান আছে।
আমাদের চেষ্টার ফল হিসেবে ফ্রেড হ্যারিস ও অ্যালান কার্টিসের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে হিলিং আওয়ার ডিভাইডেড সোসাইটি: ইনভেস্টিং ইন আমেরিকা ফিফটি ইয়ার্স আফটার দ্য কারনার রিপোর্ট শীর্ষক একটি বই, যা পড়ে পাঠকের মন খারাপ হবে।
আমার অধ্যায়ে লিখেছি, ‘কারনার রিপোর্টে শনাক্ত করা সমস্যাসংকুল কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে (যেমন সরকারে কালো আমেরিকানদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া একটি বড় উদাহরণ।) ; কিছু ক্ষেত্র আগের মতোই রয়ে গেছে (শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য) ; কিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অবনতি হয়েছে (সম্পদ ও আয়বৈষম্য)।’
গত অর্ধশতাব্দীতে নাগরিক অধিকার আন্দোলন একটা পরিবর্তন এনেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মোটা দাগে চোখে ধরা পড়ে এমন বেশ কিছু বৈষম্য বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। সমাজবদ্ধ জীবনযাত্রার মানদণ্ড পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু গভীরভাবে গেড়ে বসা এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেওয়া বর্ণবাদের শিকড় উৎপাটন কঠিন প্রমাণিত হয়েছে।
নতুন প্রতিবেদনের মূল বার্তায় নাগরিক অধিকারের মহান নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সেই বাণী প্রতিফলিত হয়েছে: আফ্রিকান-আমেরিকানদের অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার অর্জনকে সমস্ত আমেরিকানের অর্থনৈতিক সুযোগ থেকে আলাদা করে দেখা যাবে না।
লুথার কিংয়ের সেই সময় থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক বৈষম্য আরও বেড়েছে। যাদের কলেজ পর্যায়ের ডিগ্রি নেই, তারা এই বৈষম্যের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। আর আমেরিকায় বসবাসকারী আফ্রিকান-আমেরিকানদের তিন-চতুর্থাংশই এই শ্রেণিভুক্ত।
আমেরিকার আর্থিক খাত আফ্রিকান-আমেরিকানদের ব্যবহার করার টার্গেট করে আসছে। বিশেষ করে আর্থিক সংকটগুলো শুরু হওয়ার আগের বছরগুলোতে দেখা গেছে তাদের সহজে ঋণ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জিনিসপত্র কিংবা সম্পত্তি চড়া দামে বিক্রি করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারা সেই ঋণ শোধ করতে পারেনি। এভাবে হাজার হাজার আফ্রিকান-আমেরিকান তাদের বাড়িঘর হারিয়েছে এবং সমাজের বিদ্যমান বৈষম্য আগের চেয়ে বেড়ে গেছে।
তবে এটাও ঠিক যে আমাদের সামনে বেশ কিছু আশার দিক আছে। যেমন, বৈষম্য সম্পর্কে আমাদের ভাবনাচিন্তার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, এখন আমরা স্বীকার করতে শুরু করেছি, বৈষম্যের কারণে, বিশেষ করে বর্ণবৈষম্যের কারণে আমেরিকাকে চড়া মূল্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।
সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, মার্কিন জনগণের একটা অংশের, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে আন্দোলন শুরু হচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে, আমেরিকাকে তার মূল্যবোধের পথে আসতে হবে।
আমি আমার অধ্যায়ের উপসংহার টেনেছি এই বলে: ‘বিকল্প এক পৃথিবী গড়া সম্ভব, কিন্তু ৫০ বছরের সংগ্রাম আমাদের দেখিয়েছে সেই বিকল্প রূপকল্পে পৌঁছানো কত কঠিন।’
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ ই. স্টিগলিৎস নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও লেখক