কোটা-বৈষম্যের প্রতিবাদ ও ঝাড়ু কর্মসূচি

১৯৩১ সালের আদমশুমারিতে দেখা গেছে, ১০ শতাংশ উচ্চবর্ণই প্রায় শতভাগ সুবিধার মালিক। আর জনসংখ্যার বাকি অংশ জন্মের পাপ নিয়ে বঞ্চিত। সেটাও ছিল একধরনের কোটা। সে সময় পূর্বপুরুষের জমিজমা ও শিক্ষার সুযোগ এবং নিম্নবর্ণ ও নিম্নশ্রেণির কৃষকদের পিছিয়ে পড়ার কারণে চাকরি-বাকরির বেশির ভাগই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও জমিদারশ্রেণির কুক্ষিগত হয়ে ছিল। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও কোটাব্যবস্থার নামে সে রকমই এক অগ্রাধিকারের ব্যবস্থা চালু আছে। কোটার সেই ফাঁক আর দূর হলো না।

এই রাষ্ট্রের সংবিধানে ধর্ম-লিঙ্গ-জাতি-আঞ্চলিক ও কৃষক-শ্রমিকের বঞ্চনার কথা স্বীকার করা হয়েছে। সে কারণে বর্তমান কোটাব্যবস্থায় নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, আদিবাসী ৫ শতাংশ ও প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ—এই মোট ২৬ শতাংশ কোটা নিয়ে কেউ কথা তোলেনি। এর বাইরে আছে পোষ্য কোটার ২০ শতাংশ, যার কথা কোথাও উল্লেখ করা নেই। যার মা-বাবা সরকারের যে বিভাগে চাকরি করেছেন, সেখানটা যেন তাঁর সন্তানদের তালুক। স্বাধীনতার পরপরই ওপরের কোটাগুলোর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু করা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিদের সুবিধাদানের ব্যবস্থা করা হয়। আর এই সুবিধা পেতে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টি হচ্ছে দেদার। নয়া সরকার মানেই নয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকা। ব্রিটিশরা যেভাবে অনুগত জমিদারগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে, কোটার মুলা ঝুলিয়ে এখানেও অনেকটা তা-ই করা হয়েছে।

আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমাদের পিতারা এই দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন, অতএব...। এ রকমটা কেউ কেউ ভাবতে পারেন। কিন্তু আমার মতো মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কাছে কোটাসুবিধা নেওয়া অপমানজনক, পিতাদের কাছেও। আমরা প্রশ্ন করতে চাই, দেশটা কি তবে ভাগ-বাঁটোয়ারার জিনিস? আর এই ভাগের বখরা বিলাতে গিয়ে জন্ম দেওয়া হয়েছে আরও আরও বৈষম্যের। আমরা সব ধরনের কোটার বিপক্ষে নই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৪৭ বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরাও যখন আর সরকারি চাকরিপ্রার্থীর বয়সে নেই, তখন তাঁদের নাতিপুতি ও পোষ্যদের সুযোগ দিতে গিয়ে বিপুলসংখ্যক বেকারকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠবেই। প্রশ্ন উঠেছে এবং তরুণেরা কোটা সংস্কারের আন্দোলন চালাচ্ছেন। এর সঙ্গে সংহতি জানানো ব্যক্তিগতভাবে কর্তব্য মনে করি।

২.
আন্দোলনের লক্ষ্য যেমন গণতান্ত্রিক হতে হয়, তেমনি তার কর্মসূচিকেও হতে হয় মানবিক। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বৈষম্যের শিকারকে উপহাস করতে পারে না। কথাটা বলার প্রসঙ্গ এল আন্দোলনের একটা কর্মসূচির কারণে। কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীরা প্রতিবাদ হিসেবে সম্প্রতি রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কর্মসূচি নিয়েছেন। কিছুদিন আগে ভারতেও কোটার বিরোধিতা করতে গিয়ে আন্দোলনকারীরা জুতা পালিশের কর্মসূচি নিয়েছিলেন। কিন্তু এ ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজকে আমরা কোন বার্তা দিচ্ছি? ঝাড়ু দেওয়া কি নীচু কাজ? সমাজের বঞ্চিত যে শ্রেণিটি ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করে, এর মাধ্যমে তাদের কি হেয় করছি না? শিক্ষার গর্বে কম শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত ঝাড়ুদারদের তুচ্ছ করাটা কি গ্রহণযোগ্য হয়? এর দ্বারা সমাজের সামনে আমরা কোন আদর্শ স্থাপন করতে চাইছি?

আমাদের অনেকে উচ্চশিক্ষিত, কিন্তু বিদেশে গিয়ে ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠন। আমরা কোটার সংস্কার চাইতে গিয়ে যেন আমাদের পূর্বপুরুষদের অপমান না করে বসি। কোটার সংস্কার তো চাই সংবিধানবর্ণিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্যই।

৩.
ব্রাহ্মসমাজের সদস্য ও শিবনাথ শাস্ত্রীর শিষ্য আনন্দচন্দ্র মিত্র নামের একজন শিক্ষক, যিনি ময়মনসিংহে শিক্ষকতা করতেন। তিনি ১৮৭৬ সালে রাষ্ট্রনীতিবিষয়ক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। সেটির নাম ছিল ‘ব্যবহার দর্শন’, যার শিরোনামের নিচে ইংরেজিতে লেখা ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু দ্য সায়েন্স অব পলিটিকস’। আনন্দচন্দ্র মিত্র সায়েন্স অব পলিটিকস বলতে ব্যবহার দর্শন বুঝতেন। সেখানে বলেছেন, ‘যে সমাজে রাজশক্তি ও প্রজাশক্তি সম্মিলিত হইয়া কার্য্য করে, তাহাকে রাজ্য বলে। সমুদয় প্রজাশক্তি সম্মিলিত হইয়াই রাজশক্তির সৃষ্টি করে, এবং সেই রাজশক্তির বশীভূত হইতে আপনা হইতেই বাধ্য হয়। রাজশক্তিও আবার প্রজাশক্তির এমন আয়ত্ত থাকে, যে কোন ক্রমেই প্রজাশক্তিকে উপেক্ষা করিয়া কোন কার্য্য করিতে পারে না। যে সমাজে এই রূপে কার্য্য চলে তাহাই প্রকৃত রাজ্য।’

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তো আমরা এমন রাষ্ট্রই সৃষ্টি করতে চেয়েছিলাম। যেখানে নাগরিকদের ন্যায্য দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া হবে। সরকার যদি কোনো সমস্যা বুঝতে না পারে, তখন আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের বোঝানোর সুযোগটা খোলা রাখতে হবে। কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সরকারের হুঁশ ফিরুক। আমরা সরকারকে মনে করাতে চাই যে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ঘোষিত নীতিই তো ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। ‘নীতি’ শব্দটি ‘নী’ ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার মানে হচ্ছে টেনে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ যে বিদ্যার সাহায্যে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়, তাই নীতি। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পূর্বপুরুষদের এই বৈষম্যবিরোধী নীতিই টেনে নিয়ে গেছে। সাতই মার্চের ভাষণের কথা ধার করে বলি, কী পেলাম আমরা? আমাদেরও কি দাবায়ে রাখা হবে?

নাহিদ হাসান: প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম।
[email protected]