আন্তক্যাডার বৈষম্য কীভাবে দূর হবে

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) ২৭টি ক্যাডার রয়েছে। আছে বেশ কিছু সাব-ক্যাডারও। অভিযোগ রয়েছে এসব ক্যাডার, সাব-ক্যাডারের কোনো কোনোটি অন্যদের থেকে সুযোগ-সুবিধা কম পায়। পদোন্নতিতে রয়েছে বৈষম্য, এমন কথাও বলা হয়। এসব কথার পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয় যে একই বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সবাই চাকরিতে এসেছেন। সুতরাং এখানে বৈষম্য কাম্য হতে পারে না। কথাগুলো ফেলে দেওয়া যাবে না। তবে বাস্তবতা যাচাই করে দেখারও প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন আছে সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ন্যায়সংগত প্রতিকারের ব্যবস্থা করা।

এটা সত্যি, একই বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সবাই চাকরিতে আসেন। এর মধ্যে প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশসহ সাধারণ ক্যাডারে আসেন সাধারণত প্রতি ব্যাচে ৬ থেকে ৭ শ। তাঁরা সুদীর্ঘ একটি তালিকা থেকে মেধা, প্রাধিকার কোটা ও পছন্দের ক্রম অনুসারে স্থান পান এসব পদে। যাঁদের স্থান হয়
না, তাঁদের জন্য হালে নন-ক্যাডার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কিছু পদের ব্যবস্থা হয়েছে। আর বিশেষায়িত ক্যাডারেও নিজ নিজ ক্ষেত্রে একই ভিত্তিতে নিয়োগ পান।

তাহলে দেখা যায়, একই পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে এলেও প্রত্যেকের মেধাক্রম অভিন্ন নয়। আর অধিকতর মেধাবীরা তাঁদের পছন্দ অনুসারে আকর্ষণীয় চাকরিগুলো পাবেন, এটাও স্বাভাবিক। এখানে প্রাধিকার কোটারও প্রভাব রয়েছে। এর যৌক্তিকতার প্রশ্ন নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে ও হচ্ছে। আজকের নিবন্ধের প্রতিপাদ্য এটা নয়। উল্লেখ্য, চাকরির সুযোগ-সুবিধা সাধারণত নির্ধারণ করা হয় তার কর্মপরিধি অনুসারে। এটা অনেক ক্ষেত্রেই অভিন্ন হবে না, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। তেমনি পদোন্নতির সুবিধাদিও সে রকমই হওয়ার কথা। আর চাকরিতে সবাই এসেছেন নিজেদের মেধাক্রম, প্রাধিকার কোটা আর পছন্দের ভিত্তিতে।

প্রতিটি চাকরির সুযোগ-সুবিধা অভিন্ন নয়। যেমন পররাষ্ট্র ক্যাডারে যাঁরা নিয়োগ পান, তাঁরা বিদেশে পদায়নকালে বিদেশ ভাতা, আপ্যায়ন ভাতা, চিকিৎসার সব সুযোগ, সন্তানদের পড়াশোনার ভাতা ইত্যাদি পেয়ে থাকেন। সরকারি ব্যয়ে নিতে পারেন একজন গৃহপরিচারক। রাষ্ট্রদূতেরা সরকারি খরচে একজন বাবুর্চি ও একজন মালি নিয়োগ দিতে পারেন। এগুলো সবই যৌক্তিক। তেমনি মাঠ প্রশাসনে কর্মরত থাকাকালে একজন ডিসি বা এসপি সহায়ক কর্মচারীর সুবিধা পান তাঁদের বাসভবনে। আছে ভালো গাড়ির সুবিধাও। তাঁদের জুনিয়র সহকর্মীরাও কর্মপরিধি বিবেচনায় ক্ষেত্রবিশেষে গাড়ির সুবিধা পেয়ে থাকেন। নানা ধরনের সুযোগ রয়েছে প্রকৌশল ও বন ক্যাডারেও।

যাঁরা এ ব্যবস্থাকে বৈষম্যমূলক বলে মনে করেন, তাঁদের জন্য এসব চাকরির দ্বার রুদ্ধ ছিল না। তবে বিভিন্ন স্তরে বেতনকাঠামো তো অভিন্ন। সেটা কলেজশিক্ষক, কৃষিবিদ, কূটনীতিক, পুলিশ থেকে প্রশাসনের সদস্য—সবার জন্য প্রযোজ্য। গাড়ির ব্যাপার নিয়েই কথাটা বেশি আসে। অথচ গাড়ি পদমর্যাদার প্রতীক নয়। থানায় কোনো বিসিএস কর্মকর্তা নেই। সেখানে বেশ আগে থেকেই দেওয়া ছিল একটি গাড়ি। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার প্রয়োজনে সেখানে সত্যিকার অর্থে একাধিক গাড়ির প্রয়োজন।

পদোন্নতির সুযোগ নিয়ে কথা বলা চলে। এটা স্মরণে রাখা দরকার প্রতি ক্যাডার, সাব-ক্যাডারে গঠনকাঠামো এক রকম নয়। এ ক্ষেত্রে একই সময়ে চাকরিতে প্রবেশ করে বিভিন্ন ক্যাডারে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পদোন্নতি হতে পারে। ১৯৭৭ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যখন উপসচিব, তখন পররাষ্ট্র ক্যাডারের সদস্যরা মহাপরিচালক/রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। তেমনি হিসাব ও নিরীক্ষা ক্যাডারের সদস্যরা পদোন্নতি পেয়েছেন যুগ্ম সচিব পদে। কর ও শুল্ক ক্যাডারের সদস্যরা হয়ে গেছেন কমিশনার। এখনো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ইউএনও, এডিসি থাকাকালেই তাঁদের ব্যাচমেটরা পররাষ্ট্র ক্যাডারে পরিচালক, পুলিশে এসপি ইত্যাদি পদে চলে যান। এমনটা হবেই। এটা জেনে ও মেনেই সবাই চাকরিতে এসেছেন।

বিসিএসের সবচেয়ে বড় দুটো ক্যাডার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য ক্যাডারে প্রবেশ পদে থেকে উচ্চতর ডিগ্রি করতে না পারলে ঢিমেতালে চলতে থাকে জীবন। ব্যাচমেটরা সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক হয়ে যান। তাঁরা হাবুডুবু খেতে থাকেন সিভিল সার্জন হতেও। এটাকে কি আমরা বৈষম্য বলতে পারি? মোটেই না। চিকিৎসাবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি ও গবেষণা অতিমূল্যবান। সেটা মূল্যায়ন করেই ওপরের দিকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এখানে জ্যেষ্ঠতা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ নিয়ে কারও ক্ষোভ থাকলেও কিছুই করার নেই।

বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে কয়েকটি সাব-ক্যাডার রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় সাব-ক্যাডার সাধারণ শিক্ষা। এখানে কমবেশি ৮০টি বিষয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। পদগুলো বিশেষায়িত বলে ইতিহাসের অধ্যাপক পদ খালি হলে পদার্থবিদ্যার সহযোগী অধ্যাপককে পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং একই ব্যাচে চাকরি পাওয়া শিক্ষকেরা ওপরের স্তরে একই সময়ে পদোন্নতি না-ও পেতে পারেন। ক্ষেত্রবিশেষে অপেক্ষাকাল হতে পারে দীর্ঘতর।

একটি দিকে আঙুল তুলে অনেকেই দেখান। সেটা সচিবালয়ে নির্ধারিত পদসংখ্যার বিপরীতে হাল আমলে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা। এটা সত্যি কথা যে এখানে গত কয়েক বছর শূন্যপদ ব্যতিরেকে পদোন্নতি দিতে গিয়ে শৃঙ্খলা বিপন্ন হচ্ছে। তদুপরি এ পদগুলোর সিংহভাগেই আছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের তাঁদের নির্ধারিত সংখ্যার অনেক কম পদ দেওয়া হয়েছে, এমনটা বলা হয়। তা হয়ে থাকলে খুবই অসংগত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা বেশ কিছু থাকার কথা। অবশ্য কিছু কিছু ক্যাডারের নিজস্ব লাইন পদে পদোন্নতির ভালো সুযোগ থাকায় তাঁরা উপসচিব স্তরে আসতে চান না। এর মধ্যে পুলিশ, শুল্ক, কর ইত্যাদি ক্যাডারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা চলে।

তবে অন্য ক্যাডারগুলোর নির্ধারিত সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব না থাকার ক্ষোভ যৌক্তিক। অন্যদিকে এভাবে পদোন্নতি দিয়ে সচিবালয় প্রশাসনকে ভারসাম্যহীন করা হয়েছে। ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া শুধু একটি বিভাগের চিত্র উল্লেখ করলে দেখা যাবে, সে বিভাগে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব পদে কর্মরত রয়েছেন যথাক্রমে ১১, ৬, ৩৩ এবং ১০ জন কর্মকর্তা। শীর্ষস্থানে একজন থাকলেও এ পিরামিডটির আকৃতি অনুমান করলে এর ভারসাম্যহীনতা বুঝতে প্রশাসন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন পড়ে না। পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বেতন-ভাতা, সুবিধাদি পাচ্ছেন।
অনেকেই কাজ করেন এক বা একাধিক ধাপ নিচে। তাহলে ধরে নিতে হবে এ পদোন্নতির সঙ্গে জনস্বার্থের সংশ্লিষ্টতা নেই। যা-ই হোক, এখন অন্তত রাশ টেনে ধরুন। এর কারণ বিভিন্ন। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনতে পারলে তা আন্তক্যাডার বৈষম্য কমাতেও সহায়ক হবে।

আর তা ন্যায়সংগতভাবে করতে হলে উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ করার দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে সরকারি কর্ম কমিশনকে (পিএসসি)। হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও এ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ-প্রক্রিয়ার ওপর মোটামুটি আস্থা রয়েছে অনেকের। অযাচিত বিলম্বসহ অনেক অভিযোগ থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি গ্রহণযোগ্যতা হারায়নি। পদোন্নতির সুপারিশ করা হবে চাকরিজীবনের ইতিবৃত্ত এবং অভিজ্ঞতার পাশাপাশি লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে। আর অবশ্যই শূন্য পদের বিপরীতে এবং মেধার ক্রমানুসারে।

এমনটাই প্রস্তাবিত ব্যবস্থা ছিল এ সরকারের গত আমলে তৈরি সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়ায়। সে খসড়াটি অজ্ঞাত কারণে বাদ পড়ল। এতে দলীয়করণের অভিযোগটিও তেমন আসবে না। সরকার কাউকে চাকরির ভিত্তিস্তরে নিয়োগ দেওয়ার সময়ে কোনো স্তর পর্যন্ত পদোন্নতি দেওয়ার নিশ্চয়তা দেয়নি। সুতরাং একটি নির্ধারিত মেয়াদান্তেই বিশেষ বিশেষ ব্যাচ চাকরিতে কত বছর হলো, সে যুক্তিতে পদোন্নতি দাবি করছে। সফলও হচ্ছে। এমনটা না করলে আন্তক্যাডার বৈষম্যের যে অভিযোগ আসছে, তার যৌক্তিকতা দুর্বল হয়ে যেত।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব