হার্ট অ্যাটাক: গোল্ডেন আওয়ার

কারও হার্ট অ্যাটাক হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যেতে হবে। কারণ, হার্ট অ্যাটাকের পর প্রথম এক ঘণ্টা হলো গোল্ডেন আওয়ার, অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসকের জরুরি চিকিৎসা নিতে পারলে রোগীর প্রাণ রক্ষা প্রায় নিশ্চিত করা সম্ভব।

প্রশ্ন হলো আমরা কীভাবে বুঝব হার্ট অ্যাটাক, না গ্যাসের কারণে বুকব্যথা। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে অনেক সময় চলে যায়। বুকব্যথা চরমে উঠলে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। রোগীর জীবন সংশয় দেখা দেয়। তারপরও চিকিৎসকেরা চেষ্টা করেন। যদি হার্ট অ্যাটাকের তীব্রতা কম হয়ে থাকে, তাহলে হয়তো প্রাণ রক্ষা পায়। কিন্তু বাকি জীবন কষ্ট করে চলতে হয়। কারণ, হার্ট অ্যাটাকের ফলে হৃৎপিণ্ডের কিছু অংশ অকেজো হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত হয়তো চরম ঝুঁকিতে পড়তে হয়।

এই গোল্ডেন আওয়ারের কথাটা সেদিন স্মরণ করিয়ে দিলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের সহযোগিতায় প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশে হার্ট অ্যাটাক পরিস্থিতি ও করণীয় বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেখানে জাতীয় অধ্যাপক আবদুল মালিকসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা ছিলেন, ছিলেন পিকেএসএফের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। গ্রামের অসচ্ছল মানুষের জন্য চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া এবং হার্ট অ্যাটাকের মতো ভয়াবহ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়ে আলোচনা হয়, কিছু পরামর্শও দেওয়া হয়।

গোল্ডেন আওয়ারের প্রসঙ্গ আসে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর। কিন্তু তার চেয়ে সতর্কতা বেশি দরকার। একটু সচেতন থাকলে হয়তো এমন ভয়াবহ অসুখ হবেই না। বিড়ি-সিগারেট, তামাক সেবন, অতিরিক্ত চর্বি, পোড়া তেলের রান্না খাবার, বিশৃঙ্খল জীবনযাপন এড়িয়ে চললে ঝুঁকি কমে যায়। বেশি রাত না জাগা, সকালে ঘুম থেকে উঠে একটু হাঁটা বা হালকা দৌড়, পরিমিত খাবার; শাকসবজি, ফলমূল বেশি খাওয়া। প্রসেসড ফুড বা প্রক্রিয়াজাত খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এগুলো নিয়মিত খাওয়া চলবে না। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

চিনি পুরোপুরি বাদ দিতে হবে। আজকাল চিনিকে বলা হয় ‘সাদা বিষ’! কারণ, আমরা যে ভাত বা মিষ্টি ফল খাই, সেখান থেকেই বিপাক প্রক্রিয়ায় শরীর চিনি পায়। সেই সঙ্গে পায় প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান, ভিটামিন প্রভৃতি। কিন্তু চিনি খেলে শরীরের বিপাক প্রক্রিয়ার কিছুই করার থাকে না, সেটা সরাসরি রক্তে চলে যায়। শরীর অন্য উপাদান থেকে বঞ্চিত হয়, ওজন বাড়ে। আমেরিকার ড. রবার্ট লাস্টিং চিনির বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। সবাই তাঁকে ‘অ্যান্টিসুগার গাই’ নামে চেনেন। তবে তিনি নিজে ‘অ্যান্টিপ্রসেসড ফুড গাই’ নামে পরিচিত হতেই ভালোবাসেন। কারণ, বিশ্বব্যাপী যে ওজন বৃদ্ধির বিপদ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা চিনি এবং ‘প্রসেসড ফুড’ বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের জন্য। তিনি এর ঘোর বিরোধী। এটা যে শুধু হৃদরোগের বিপদ ডেকে আনে তা-ই নয়, হাজার রকম রোগব্যাধির জন্য এ দুটি উপাদান সবচেয়ে বেশি দায়ী। এর সঙ্গে রয়েছে সিগারেট, তামাক। এগুলো একেবারে বাদ দিতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে নানা ঘটনার চাপে দুশ্চিন্তা হয়, ফলে রক্তচাপ বাড়ে। এটা হার্ট অ্যাটাকের একটা বড় কারণ। এর একটা মহৌষধ নিয়মিত ব্যায়াম।

আমরা যদি মনে করি, একটি দিন ২৪ ঘণ্টায় নয়, ২৩ ঘণ্টায়, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়। কারণ, বাকি এক ঘণ্টা ব্যায়ামের জন্য রাখতে পারি। এই ব্যায়াম খুব সাধারণ। সবাইকে যে জিমে বা সুইমিংপুলে যেতে হবে তা নয়। যাঁর সাধ্য আছে, যাবেন। কিন্তু সকালে রাস্তায় ২০ মিনিট জোরে হাঁটা আর সেই সঙ্গে ৫ মিনিটের দৌড়ে বেশ কাজ হয়। সকালে ব্যায়ামের সুবিধা হলো এ সময় শহরের বাতাসে ধুলাবালু কম থাকে। তবে চিকিৎসকদের অনেকে বলেন, সকালে নয়, বিকেলে হাঁটা হার্টের জন্য ভালো। কারণ, সারারাত ঘুমের পর শরীরের সব যন্ত্রপাতি পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত হতে কিছু সময় লাগে। তবে অনেক চিকিৎসক মনে করেন, যাঁর যা অভ্যাস। যিনি সকালে হেঁটে অভ্যস্ত তিনি সকালে, আর না হলে বিকেলে হাঁটবেন।

প্রতিদিন মোট ২৫ মিনিট হাঁটা ও হালকা দৌড় খুব দরকার। এটা শরীর ফিট রাখার অন্যতম কৌশল। আর শরীর ঠিক তো হার্টও ঠিক। বিশেষভাবে যাঁদের বয়স ৪০-৫০-এর বেশি, তাঁদের জন্য এই ব্যায়াম দরকার। বাকি ৩৫ মিনিট কী ব্যায়াম করব? কোনো সমস্যা নেই। পাঁচ-দশ মিনিট ব্রিদিং এক্সারসাইজ। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলা। হার্ট ঠিক রাখার জন্য এর চেয়ে ভালো ব্যায়াম আর হতে পারে না। সারা দিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে পাঁচ-সাত মিনিট করে হাঁটা, চলাফেরা। এটাই যথেষ্ট। এখানে বলা দরকার, এই সব ঘড়ি ধরে ব্যায়াম কিন্তু দেশের ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষের জন্য নয়। তাঁরা তো সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছেন। বাড়তি ব্যায়ামের তেমন দরকার নেই।

প্রতিদিন কিছুক্ষণ জোরে হাঁটার অভ্যাস থাকলে সহজেই হৃদ্রোগে মৃত্যুঝুঁকি এড়ানো যায়। কীভাবে? হার্টে কোনো গন্ডগোল থাকলে এই হাঁটার মধ্যে টের পাওয়া যাবে। যেমন কারও হার্টে ব্লক সৃষ্টি হলে ১০-১২ মিনিট একটানা মধ্যম গতিতে হাঁটলেও হাতের তালু বা আঙুল, ঘাড়, কাঁধ, বুকের বাঁ দিকে হালকা ব্যথা হবেই। এটাই হার্টের অসুখের প্রাথমিক লক্ষণ। তার মানে, ১০-১২ মিনিটের বেশি একটানা জোরে হাঁটার জন্য যে অতিরিক্ত শক্তি দরকার এবং তার জন্য যে অতিরিক্ত রক্ত সঞ্চালন দরকার, সেটা হার্ট দিতে পারছে না। বুঝতে হবে হার্টে ব্লক থাকতে পারে। তখনই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া দরকার। সমস্যা থাকলে হার্ট অ্যাটাকের আগেই ব্লক সরিয়ে নেওয়া যায়। সেটা এনজিওপ্লাস্টি বা বাইপাস, যার মাধ্যমেই হোক, চিকিৎসা সম্ভব এবং আমাদের দেশেই এখন খুব কম খরচে হার্টের এসব চিকিৎসা পাওয়া যায়। বিদেশে যাওয়ার দরকার নেই।

হার্ট অ্যাটাকের আগেই ব্লক সরিয়ে ফেললে পরবর্তী ১৫-২০ বছরের জন্য নিরাপদ থাকা যায়। তাই হার্ট অ্যাটাক থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো নিয়মিত ব্যায়াম। এর চেয়ে বড় ওষুধ আর নেই। একে বলা যায় হার্ট অ্যাটাকের আগে প্রতিদিনের ‘গোল্ডেন আওয়ার’।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক