খণ্ড খণ্ড তথ্যের অখণ্ড ইতিহাস

.
.

মো. মর্ত্তুজা হোসেনের বর্ণনা পড়ছিলাম। গা শিরশির করছিল। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন পুলিশের সার্জেন্ট। এক অবাঙালি সহকর্মী তাঁকে হানাদার বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। মর্ত্তুজার সঙ্গে তাঁর আরও দুজন সহকর্মীকে চোখ বেঁধে পশুর মতো পেটানো হলো। পরে চোখ বাঁধা অবস্থায় ট্রাকে করে তাঁদের পাকিস্তানি বাহিনীর সেক্টরস হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে যেতেই এক ব্রিগেডিয়ার বলেন, ‘গুলি করে মেরে ফেলো!’ নির্দেশ পেয়ে তাঁদের মতিঝিল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের সেনা ক্যাম্পে এনে মাঠের মধ্যে বেঁধে রাখা হলো।

একপর্যায়ে একজন মেজর এসে মর্ত্তুজাকে বলেন, তিনি জেনেছেন তাঁর (মর্ত্তুজা) দুটি শিশুকন্যা আছে। তিনি কাছে এসে কানে কানে বলেন, ‘তোমাদের ব্রিগেডিয়ার সাহেব হত্যার আদেশ দিলেও আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তোমাদের ফাঁকা গুলি করে ছেড়ে দেব।’ বলেন, যত দিন সামরিক শাসন থাকবে, তত দিন খাতা-কলমে তাঁকে ‘মৃত’ হিসেবে বেঁচে থাকতে হবে। এ কথা জানাজানি হলে দুজনেরই (মর্ত্তুজা ও ওই মেজর) পরিবারের সবাইকে সেনারা মেরে ফেলবে।

গভীর রাতে তাঁদের মেরে ফেলার জন্য মতিঝিলে আনা হলো। মেজর সাহেব বললেন, ‘ফায়ার!’ সঙ্গে থাকা নায়েক সুবেদার ফাঁকা গুলি করলেন। মর্ত্তুজা লিখেছেন, ‘পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর সাহেব আমার কাছে এসে হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে বললেন, “তোমাকে যেসব অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে, আমরা তা খতিয়ে দেখে তেমন কিছুই না পাওয়ায় তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি। তোমার দুটি মাসুম মেয়েকে এতিম করতে পারলাম না। অন্ধকার থাকতে থাকতে পালাও। অফিশিয়ালি ইউ আর ডেড ফ্রম টুডে। ব্রিগেডিয়ারের কাছে ডেড লিস্ট পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’” পরে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন মর্ত্তুজা।

এই মর্ত্তুজা হোসেন হলেন সেই ব্যক্তি, যাঁর নির্দেশে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের অস্ত্রাগারের তালা ভাঙা হয় এবং সেই অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন পুলিশ বাহিনীর যোদ্ধারা। ওই সময় রাজারবাগ ওয়্যারলেস বেজ স্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন মো. শাহজাহান মিয়া। পাকিস্তানি বাহিনী আসছে জেনে তিনি সারা দেশে মেসেজ পাঠিয়ে দেন, ‘বেজ, ফর অল স্টেশনস ফর ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই দ্য পাক আর্মি, ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেলভ, ওভার!’ হামলার পর তিনিও যুদ্ধ চালাতে থাকেন। ফজরের আগে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা পাঁচজন পাকিস্তানি সেনাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেন। কিন্তু একটু পরই তাঁরা বন্দী হন। তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ২৮ মার্চ তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সংকলনগ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ বইটিতে এভাবেই নিজের লেখায় বর্ণনা দিয়েছেন মো. মর্ত্তুজা ও শাহজাহান মিয়ার মতো পুলিশ যোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা। ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ প্রকাশ করেছে বইটি। বইটি সম্পাদনা করেছেন বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম।

আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হামলা করার পর সেকেলে থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে পুলিশ সদস্যরা প্রাণপণ লড়াই চালিয়েছিলেন। হানাদার বাহিনীকে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, খুব সহজে বাঙালিদের দমন করা যাবে না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে হানাদারদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রথম সম্মিলিত প্রতিরোধ।

  ২৫ মার্চ রাতের সেই গণহত্যার ইতিহাস একক কোনো অভিসন্দর্ভ, গবেষণাপত্র, বই, প্রামাণ্যচিত্র, ছবি বা অন্য কোনো কিছু দিয়ে তুলে ধরা অসম্ভব। এসব মাধ্যমে এই বিশাল ক্যানভাসের বড়জোর টুকরো টুকরো অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করা যেতে পারে। 

 মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ বইটি তেমনই একটি টুকরো। সেখানে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে যা ঘটেছিল, তার একটি ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। সেই ছবি থেকে অন্তত এটুকু বোঝা গেছে, রাজারবাগে সেদিন পুলিশ বাহিনী আধুনিক অস্ত্রসম্ভারের বিরুদ্ধে টিকতে না পেরে পিছু হটেছিল, এটা সত্যি। এটা সত্যি যে অনেকে সেদিন শহীদ হয়েছিলেন, অনেকে বন্দী হয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন কেউ হেরে যাননি। 

প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়া পুলিশ সদস্যদের বয়ান, আশপাশে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারাভাষ্য, দাপ্তরিক তথ্য এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের স্মৃতিচারণার সম্মিলনে ঋদ্ধ এই বই। বইটিতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের পাশাপাশি অতি মূল্যবান ঐতিহাসিক তথ্য উঠে এসেছে।

সারফুদ্দিন আহমেদপ্রথম আলোর জে্যষ্ঠ সহ–সম্পাদক