শেকড়ের সন্ধানে, ১৯৭১-এর স্মৃতি

ভাই সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সঙ্গে শরীফ হাসান।
ভাই সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সঙ্গে শরীফ হাসান।

গিয়েছিলাম মহেশখলা। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বাগমারা জেলার একটি গ্রাম। মহেশখলা আমার হৃদয়ে প্রোথিত একটি নাম। সেখানে আমার পরিবার ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বসতি স্থাপন করেছিল। আমার বাবা ১৯৭০ সালের তদানীন্তন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। মূলত এ নির্বাচনী ফলাফল ছিল বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার ম্যানডেট। ১৭০ আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়ী হয়। কিন্তু তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার এ গণরায়কে মেনে না নিয়ে সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেয়। ফলে বাঙালি তার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রবল প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের জবাবে পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র অসহায় বাঙালির ওপর শুরু করে নির্মম নির্যাতন, নিপীড়ন যা চরম আকার ধারণ করে ২৫ মার্চ রাতে, যখন পাকিস্তানি বাহিনী নিঃস্ব ঘুমন্ত বাঙালির ওপরে চালায় নির্বিচার গণহত্যা। এরই চূড়ান্ত পরিণতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। শুরু হয় মুক্তিসংগ্রাম। এরই ধারাবাহিকতায় নিরস্ত্র, নির্যাতিত বাঙালি সীমান্তবর্তী ভারতের রাজ্যগুলোয় আশ্রয় নেয়। বাঙালির এই চরম অসহায় এবং দুর্যোগময় মুহূর্তে যে দেশটি সহায়তার হস্তান্তর প্রসারিত করে সেটি হলো সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র ভারত। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাঙালির এ মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে বিশ্ব জনমত তৈরিতে যে আন্তরিক এবং জোরালো ভূমিকা রেখেছেন, তা অনস্বীকার্য। তৎকালীন ভারত সরকার তার সব সীমান্ত খুলে দেয় অসহায় বাঙালিদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য। লাখ লাখ বাঙালি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। তেমনি একটি শরণার্থীশিবির ছিল মহেশখলা। আমায় বাবা যিনি ১৯৭০ এর নির্বাচনে নেত্রকোনা জেলায় অন্তর্গত মোহনগঞ্জে-বারহাট্টা নির্বাচনী এলাকা থেকে মনোনীত সংসদ, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে অন্য সব সংসদের মতোই তার নির্বাচনী এলাকার সব মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য এবং তাদের ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের এপ্রিল মেহেমনাও হতে সড়ক এবং নদীপথে ভারতের সীমান্তবর্তী বাগমারা জেলার মহেশখলা জেলায় গমন করেন। এবং সেখানকার শরণার্থীশিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। উদ্দেশ্য একটাই। প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করা এবং স্বাধীন করা।

ভারতের পত্রিকার খবর।
ভারতের পত্রিকার খবর।

আমার বয়স তখন দুই বছর। আমার বাবা আমাকে, আমার বড় দুই ভাই, এক বোন এবং আমার মাকে রেখে চলে যান মহেশখলায়। অজানা গন্তব্য কবে আবার দেখা হবে, আদৌ হবে কি না, সবকিছুই ছিল অনিশ্চিত। মহেশখলা থেকে আমার বাবা আমার মায়ের কাছে মাঝেমধ্যে খুবই গোপনে লোকমারফত চিঠি পাঠাতেন। দু-একটা চিঠি মায়ের কাছে সংরক্ষিত ছিল। চিঠিগুলোয় বাবার আবেগ আর উত্কন্ঠাই প্রতিফলিত হয়েছিল। তার একটি চিঠি প্রথম আলো এবং গ্রামীণফোনের উদ্যোগে প্রকাশিত স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ একাত্তরের চিঠিতে ছাপা হয়েছিল। একাত্তরের চিঠি গ্রন্থটি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের তাদের পরিবার এবং আপনজনের কাছে পাঠানোসংবলিত একটি গ্রন্থ। প্রতিটি চিঠিতেই আছে গভীর দেশপ্রেম, দৃঢ়তা, ক্ষোভ, উত্কণ্ঠা এবং আবেগের ছড়াছড়ি। আমার বাবার সেই চিঠিতে তিনি তার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান (আমি), যাকে দুই বছর বয়সে ফেলে রেখে পাড়ি জমিয়েছিলেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিক শুধু দেশমাতৃকার টানে তার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন, আমার কথা মনে হলেই তিনি খুব অস্থির হয়ে যেতেন। যতবার আমি ওই চিঠিটি পড়েছি ততবারই আবেগাপ্লুত হয়েছি। কখনো অশ্রুসিক্ত হয়েছি। সেই আবেগ আর অনুভূতি থেকেই মূলত মহেশখলা যাত্রার পরিকল্পনা। অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান হলে। যখন আমার সর্বজ্যেষ্ঠ ভাই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাওয়ার দিন ঠিক করলেন—২০১৬ সালের ১৬ এপ্রিল। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মহেশখলা যাত্রা শুরু হলো ১৬ এপ্রিল সকালে। আমি এবং বড় ভাই ঢাকা থেকে সকাল আটটায় রওনা হয়ে গাজীপুর-ময়মনসিংহ হয়ে শেরপুরের নকলা উপজেলার নাকুগাঁত্ত সীমান্ত দিয়ে ভারতের ডালু সীমান্তে পৌঁছাই। সেখানে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এবং বাঘমারা জেলা প্রশাসন আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। সেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নিহত নয়জন বিএসএফের জওয়ানের স্মৃতিতে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমরা বাগমারা সার্কিট হাইসের উদ্দেমে রওনা হই। সেখানে পৌঁছাই বেলা তিনটায় (স্থানীয় সময়)। সার্কিট হাউসে রাত্রিযাপন শেষে পরদিন সকাল নয়টায় রওনা হই আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য মহেসখলার উদ্দেশে। ভারত সরকার আমার বড় ভাইকে এবং তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে আমাকেও রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে গণ্য করায় আমাদের এই পুরো সফরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা প্রদান করেছিল। বাগমারা থেকে মহেশখলা পর্যন্ত পুরো এলাকাজুড়ে প্রহরায় নিয়োজিত ছিলেন ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মীরা।

সারা রাত বৃষ্টির কারণে একটু শঙ্কিত ছিলাম আমাদের যাত্রার ব্যাপারে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা বেলা সাড়ে ১১টায় পৌঁছে যাই মহেষখলায়। স্থানটি একটি অজপাড়াগাঁ। বাঘমারা থেকে মহেষখলা পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার সড়ক যেতে আমাদের সময় লেগেছে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। সে এক ভিন্ন অনুভূতি। আমার বড় ভাই তাঁর স্মৃতিশক্তি দিয়ে চিহ্নিত করতে সক্ষম হলেন সেই জায়গাকে, যেখানে আমার বাবা তাঁর পরিবার–পরিজন নিয়ে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সাল আমার স্মৃতিতে কিছুই নেই। সবই আমার কাছে নতুন। আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। সেখান থেকে আমার মায়ের সঙ্গে মোবাইলে কথা বললাম। কিছু লোক আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে জড়ো হয়েছিল। তাদের সবাই বয়সে নবীন। এরই মাঝে একজন সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধকে পেলাম। তাঁর সঙ্গে কথা বললাম। তাঁর স্মৃতিচারণা থেকেও বুঝতে পারলাম, এই স্থানেই সেই শরণার্থীশিবিরটি ছিল।

.
.

আমার বাবার সঙ্গে অন্য যে সাংসদেরা মহেশখলা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন আবদুল হাকিম চৌধুরী এমপিএ, ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ; আবদুল খালেক এমপিএ, আটপাড়া (নেত্রকোনা)। দীর্ঘ ৪৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও মহেশখলার বর্তমান অনুন্নত এবং করুণ অবস্থাই প্রমাণ করে, ৪৭ বছর আগে ১৯৭১ সালে এই এলাকার অবস্থা আরও কী করুণ ছিল। বিদ্যুৎহীন, পানীয় জলের সুবিধাবিহীন একটি দুর্গম এলাকা, আর এখানেই আমার বাবা, মা আমরা ভাইবোনসহ বসবাস করতে হয়েছিল। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন অতিক্রান্ত হচ্ছিল একটি অনিশ্চয়তার মাঝে। মূল লক্ষ্য ছিল একটিই—তা হলো মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করা। এই সুদৃঢ় চেতনা থেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। মহেশখলা ঘণ্টাখানেক অবস্থানের পর আমরা পুনরায় বাঘমারার উদ্দেশে রওনা হই। সন্ধ্যায় বাঘমারা সার্কিট হাউসে রাত্রিযাপন করি। ১৭ এপ্রিল বিকেলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আরেক শহর তুরার উদ্দেশে রওনা হই। তুরা সার্কিট হাউসে পৌঁছাই স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটায়। জেলা প্রশাসন আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। ১৭ তারিখ তুরা সার্কিট হাউসে রাত্রিযাপন। তুরা থেকে ১৮ তারিখ সকালে আসামের গোয়ালপাড়ার উদ্দেশে রওনা দিই। সেখানে সার্কিট হাউসে রাত্রিযাপন করি। গোয়ালপাড়ায়ও জেলা প্রশাসক আমাদের উষ্ণ আতিথেয়তা প্রদান করেন। সার্কিট হাউসে রাত্রিযাপন শেষে ১৯ তারিখ সকাল পুনরায় তুরার উদ্দেমে যাত্রা। রাত্রে সার্কিট হাউসে রাত্রিযাপন। তুরার জেলা প্রশাসনের আতিথেয়তা ভোলার নয়। বিশেষ করে জেলা প্রশাসক প্রবীণ বক্সির ব্যক্তিগত এবং আন্তরিক অতিথিপরায়ণতা আমাদের বিমোহিত করেছে। পরিশেষে তুরা থেকে ২০ এপ্রিল সকালে ডালু সীমান্ত হয়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করি সকাল আটটায়। ডালু সীমান্তে পৌঁছাই সাড়ে সকাল ১০টায়। সেখানকার প্রশাসনিক আনুষ্ঠানিকতা এবং আতিথেয়তা শেষে বেলা ১১টায় বাংলাদেশ সীমান্ত নাকুগাঁও হয়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা। ঢাকার পৌঁছাই বেলা তিনটার দিকে।

এ ভ্রমণটি আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। এ ভ্রমণের মধ্যে আমি আমার শেকড় খুঁজে পেয়েছি, পেয়েছি সত্যের সন্ধান। আমার বাবা আমার কাছে যেমন চরম সত্য, তেমনিই মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা, নেতৃত্ব এবং ত্যাগ আমার কাছে তেমনই এক চরম সত্য। আমি গর্বিত একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের সন্তান হিসেবে।
এ পুরো ভ্রমণটি সম্ভব হয়েছে আমার বড় ভাইয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগে, যার ফলে আমি আমার দীর্ঘ লালিত আকাঙ্ক্ষা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত মহেশখলা দেখায় সমর্থ হয়েছি। কৃতজ্ঞতা আমার অগ্রজ ওবায়দুল হাসানকে, কৃতজ্ঞতা দুঃসময়ের বন্ধু ভারত সরকারকে।

সাইফ উল হাসান: মুক্তিযোদ্ধার সন্তান