চুপ, কোনো প্রশ্ন নয়

নরেন্দ্র মোদি
নরেন্দ্র মোদি

ভারতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন চলছে। নামেই অধিবেশন, অথচ একটা দিনও লোকসভা বা রাজ্যসভার কাজ পুরো দিনের মতো ভালোয় 

ভালোয় হতে পারছে না। টানা কত দিন ধরে যে সংসদ অচল, সেই হিসাবও ছাই গুলিয়ে যাচ্ছে। এটুকু শুধু মনে পড়ছে, এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে অধিবেশন শেষ হওয়ার কথা। এখন তো শোনা যাচ্ছে, সভা শুরুর দুই-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই যখন ভন্ডুল হয়ে যাচ্ছে, তখন আর এভাবে টেনেহিঁচড়ে টাকা শ্রাদ্ধের কী দরকার? তার চেয়ে বরং মেয়াদ পুরোনোর আগেই সংসদ অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি করে দেওয়া হোক।
যুক্তি যে নেই তা নয়। সংসদ চলার খরচ দিনে কোটি টাকার বেশি!
গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পীঠস্থানের হাল কীভাবে ফেরানো সম্ভব তা নিয়ে সরকার বা বিরোধী কারও তেমন মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হচ্ছে না। কিন্তু এই অচল অধিবেশনেই সাংসদেরা নির্লজ্জের মতো নিজেদের বেতন বাড়িয়ে নেওয়ার বিল পাস করিয়ে নিয়েছেন। পাস হয়ে গেছে সাংসদদের নানা ধরনের ভাতা বাড়ানোর বিলও। লজ্জা আর কাকে বলে!
সরকার অবশ্য লজ্জার ধার ধারছে না। গণতন্ত্রে সংসদ চালানোর প্রাথমিক ও প্রধান দায়িত্ব সরকারেরই। সংসদের ভেতর ও বাইরে সরকারের বিরোধিতা করার পূর্ণ অধিকার বিরোধীদের রয়েছে। হ্যাঁ, এ কথা অবশ্যই ঠিক যে সেই অধিকারের অর্থ শালীনতা ভাঙা নয়। নৈরাজ্য সৃষ্টি নয়। কিন্তু এটাও ঠিক, বিরোধীদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে সরকারের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া তৈরির চেষ্টা শাসক দলকেই করতে হয়। সংসদীয় মন্ত্রীর প্রধান কাজই তা। সাড়ে তিন দশক ধরে সংসদীয় কার্যক্রম দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এত নির্লিপ্ত সংসদীয় মন্ত্রী আমরা দেখিনি। এত দিন ধরে অচলাবস্থা চলছে, অথচ সংসদীয় মন্ত্রী আনন্দ কুমার একটা দিনের জন্যও সর্বদলীয় বৈঠক ডাকলেন না! বিরোধীরা বারবার বলা সত্ত্বেও সেই গরজ তিনি দেখাননি! দেখাননি বলাটা হয়তো ভুল হলো, বলা উচিত দেখাতে বলা হয়নি। পণ্ডিতেরা এ কারণেই বলে গেছেন, গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। কিন্তু ‘ব্রুট মেজরিটি’ বা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা গণতন্ত্রকে গলা টিপে মারে। ভারতে সেটাই হচ্ছে।
মার্চ মাসের ৫ তারিখ থেকে সংসদের বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে। চলবে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত। অবস্থা যা, তাতে এই এক মাসে এক দিনের জন্যও সংসদ সচল হবে কি না, বলা কঠিন। কংগ্রেস আমলে টু-জি স্পেকট্রাম বা কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়েও সংসদ অচল ছিল। কিন্তু পার্থক্য হলো সেবার কংগ্রেসের সংসদীয় মন্ত্রীদের চেষ্টার অন্ত ছিল না। বিরোধীদের ক্ষোভ প্রশমনে সরকার যুগ্ম সংসদীয় কমিটিও গঠন করেছিল। এবার সরকার বোবা ও কালা। মুখে বলছে আলোচনায় আগ্রহী, অথচ কাজে গরজ নেই বিন্দুমাত্র! সরকারের সমালোচনা করার কোনো সুযোগ তারা বিরোধীদের দিতে রাজি নয়।
কী কী কারণে সংসদ কেন অচল, সেই কারণগুলো সংক্ষেপে বলা যাক।
অধিবেশন শুরুর ঠিক আগে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের জালিয়াতির খবরটা জানাজানি হয়। মেহুল চোকসি ও নীরব মোদি নামের দুই গুজরাটি হীরা-জহরত ব্যবসায়ী সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। যে প্রক্রিয়ায় তাঁরা এই জালিয়াতি করেছেন এবং দেশ ছেড়েছেন, তার দায় কোনো দেশের সরকারই এড়াতে পারে না। দেশত্যাগের পর বিদেশে ওই দুজনকে প্রধানমন্ত্রীর সভায়ও দেখা গেছে। ‘এই যে মেহুলভাই রয়েছেন’ এমন মন্তব্যও মোদিকে করতে শোনা গেছে। বিরোধীদের কাছে এটা ছিল বিরাট অস্ত্র। দ্বিতীয় অস্ত্র, ফ্রান্স থেকে অত্যাধুনিক রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি। কংগ্রেস আমলে এ নিয়ে যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে ১২৬টি রাফায়েল কেনার কথা ছিল। এগুলোর মধ্যে ১৮টি তৈরি অবস্থায়, বাকি প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে বেঙ্গালুরুর রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড’ বা ‘হ্যাল’-এ তৈরির কথা ছিল। প্রায় চূড়ান্ত এই চুক্তি নাকচ করে নরেন্দ্র মোদি ফ্রান্স সফরে যে চুক্তিতে সই করেন, তাতে রাফায়েল আসবে ৩৬ টি, কিছু তৈরি অবস্থায়, বাকি ‘হ্যাল’ নয়, বেসরকারি সংস্থায় প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে। ২০০০ সালের চুক্তি অনুযায়ী ১২৬টি বিমানের জন্য খরচ হতো ৭৯ হাজার কোটি রুপি। অর্থাৎ, বিমানপ্রতি ৬২৯ কোটি। মোদির চুক্তিতে ৩৬টি বিমানের জন্য খরচ পড়ছে ৫৮ হাজার কোটি। বিমানপ্রতি ১ হাজার ৬১১ কোটি রুপি। কংগ্রেসের হিসাবে ৩৬টি রাফায়েলের জন্য খরচ হওয়ার কথা ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি রুপি। মোদি সরকার সেখানে খরচ করছে আড়াই গুণ বেশি!
সংসদ শুরু হওয়ামাত্র এ দুই কেলেঙ্কারি নিয়ে কংগ্রেস ও বিরোধীরা মুলতবি প্রস্তাব জমা দেয়। তারা ভেবেছিল, মুখে কুলুপ আঁটা প্রধানমন্ত্রীর মুখে বুলি ফোটানোর এটাই একমাত্র সংসদীয় উপায়। মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণের অর্থ বিরোধীদের কাছে সরকারের তিরস্কৃত হওয়া। কিন্তু মোদি তিরস্কৃত হতে চান না। জবাবদিহিতেও তাঁর ঘোরতর আপত্তি। শুরু হয় অচলাবস্থা। এই পরিস্থিতিতে সরকারের শরিক তেলেগু দেশম (টিডিপি) শুরু করে চাপের রাজনীতি। ২০১৯ সালে অন্ধ্র প্রদেশ বিধানসভার ভোট। জেতার তাগিদে টিডিপি নেতা ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু শুরু করেন নতুন চাপ। রাজ্য ভাগের সময় বিজেপি অন্ধ্র প্রদেশকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মোদি সেই প্রতিশ্রুতি পালন করেননি। চন্দ্রবাবু প্রথমে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে তাঁদের দুই প্রতিনিধিকে তুলে নিলেন। তারপর প্রত্যাহার করলেন সমর্থন। এবং একেবারে শেষে সরকারের বিরুদ্ধে নিয়ে এলেন অনাস্থা প্রস্তাব। সেই প্রস্তাবে সমর্থন দিল প্রায় সব বিরোধী দল।
অনাস্থা প্রস্তাবে সরকারের পতনের বিন্দুমাত্র আশঙ্কা নেই। কিন্তু মোদি চান না বিরোধীরা সরকারকে তুলাধোনা করুক এবং সারা দেশের মানুষ তা দেখুক।
এখান থেকেই শুরু অচলাবস্থার নবপর্ব।
প্রতিদিনের দৃশ্যপট এখন এমন। লোকসভা ও রাজ্যসভা শুরু হওয়ামাত্র তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি (টিএসআর) ও এআইএডিএমকের সদস্যরা প্ল্যাকার্ড নিয়ে সভার ওয়েলে নেমে আসছেন। টিএসআরের দাবি তাদের রাজ্যে সংরক্ষণের কোটা বাড়ানোর। এআইএডিএমকের দাবি কাবেরির জলবণ্টন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় কার্যকর হওয়ার আগে ‘কিছু একটা’ করার। দুটি দাবির একটিতেও কিছু করার ক্ষমতা কেন্দ্রের নেই। কারণ, সুপ্রিম কোর্টে রায়ে কোনো রাজ্যেই মোট সংরক্ষণ ৫০ শতাংশের বেশি করা সম্ভব নয়। কাবেরির জলবণ্টনের রায়ও সুপ্রিম কোর্টেরই দেওয়া।
লোকসভার স্পিকার ও রাজ্যসভার অধ্যক্ষের প্রতিদিনের অজুহাত, সভা অশান্ত। তাই অনাস্থা প্রস্তাব আলোচনার জন্য গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই প্রথম দেখলাম, বাজেট পাস হলো বিনা আলোচনায়। গিলোটিনে। অর্থ বিল পাস হলো বিনা আলোচনায়। গিলোটিনে। সাংসদদের বেতন ও ভাতার বিল পাস হয়ে গেল বিনা আলোচনায়। সরকারের যা দরকার, হট্টগোলের মধ্যেই তা পাস বলে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চৌত্রিশ বছরে এমন সংসদ পরিচালনা দেখিনি!
অথচ অন্ধ্র প্রদেশ ভাগ করার বিল যেদিন লোকসভায় আসে, রাজ্যভাগের বিরোধীরা সেদিন মন্ত্রীর হাত থেকে বিল কেড়ে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। গোলমরিচ স্প্রে করে সভা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তৎকালীন অধ্যক্ষ মার্শাল ডেকে দুর্বিনীত সাংসদদের সভা থেকে বের করে, সাসপেন্ড করে সভা শুরু করেছিলেন। গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ থাকলে এবারও অধ্যক্ষ তা করতে পারেন। কিন্তু সেই সক্রিয়তা কোথায়?
প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার অধিকার এ দেশের সাংবাদিকদের গত চার বছর ধরে নেই। একটা দিনের জন্যও নরেন্দ্র মোদি সংবাদ সম্মেলন করেননি। সংসদ অচল রেখে সংসদীয় অধিকারও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। চার বছর ধরে ভারত এক বিরল ‘মনোলগ’-এর দেশ। শুধু শোনা আর শোনা। চুপ, কোনো প্রশ্ন নয়।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি