আইনের চোখে কেউ কেউ কি বেশি সমান?

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ফাইল ছবি
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ফাইল ছবি

গত জুমার দিন এমনই ঘটনা ঘটল হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ওই যে এক মন্ত্রী ধাক্কা দিয়ে আস্ত ইমারত ফলে দেওয়ার তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন, তাঁর সেই সাবেক মন্ত্রণালয়ের জাঁদরেল আমলা যাচ্ছিলেন চট্টগ্রাম। নিজেকে তিনি ভিআইপি বা তার থেকেও বড় কিছু মনে করেন। মনে যে করেন, সেটা তাঁর হইহল্লায় বোঝা গেল। স্ক্যান মেশিনে তাঁর বাক্সপেটরা দেওয়ার পর শোরগোল করে ওঠে মেশিন। এরপর যে কাণ্ড হলো, তা বলার আগে আসুন অন্যান্য দেশের বিমানবন্দরে কী ঘটে, ভিআইপিদের সেখানে কেমন খাতির করা হয়, তা জেনে নিই।

শাহরুখ খান কি কামাল হাসান, যে-ই হোন, মার্কিন মুলুকে বিমানবন্দর নিরাপত্তা কাউকেই নাকি খাতির করে না! সবারই কাপড়চোপড় খুলতে হয়, বেল্ট-জুতা-টুপি, সবই তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়। আমাদের ফরিদপুরের জামাই জর্জ ফার্নান্দেজ সারা জীবন পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেন। বেল্টের কোনো বালাই নেই। দড়ি বা ফিতা দিয়েই পায়জামা টাইট করেন। বেল্ট না পেয়ে তাঁর পায়জামার ফিতা খুলে নিরাপত্তা তল্লাশি করা হয়েছিল ২০০২ সালে ডালাস বিমানবন্দরে। সেটা তাঁর সরকারি সফর ছিল। কেউ যদি বলে, সাদাসিধে পোশাকে ওনাকে ইন্ডিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলে মনে না হয়ে গুস্তাখি হয়ে গেছে, তাহলে বলার কিছু নেই। সেবার এসব বাড়াবাড়ি নিয়ে অনেক ঝড় উঠেছিল ভারতে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নানা মন্ত্র পড়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে বোধ হয় ভুল বোঝাবুঝি টাইপের কিছু বলে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খাসলত পাল্টায়নি। ২০০৩ সালে ব্রাজিলে যাওয়ার সময় জর্জ ফার্নান্দেজকে বিমান বদলানোর জন্য মার্কিন বিমানবন্দরে আবারও থামতে হয়। সেবারেও তাঁকে প্রায় উলঙ্গ করে দেহ তল্লাশি করা হয়। শ্রমিকনেতা জর্জ এসব নিয়ে খুব একটা রা করেননি। বাঙালবাড়ির ঝাল-ঝোল পেটে থাকলেও মগজে ছিল না। শান্তভাবেই তিনি সেসব বেয়াদবি সহ্য করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২০০৪ সালে তাঁকে মুখ খুলতে হয়, যখন সাবেক মার্কিন কূটনীতিক স্টরবি টালকোট তাঁর বইয়ে তাঁদের সেই বাহাদুরির আদ্যোপান্ত বয়ান দেন।

সম্মানী ব্যক্তিদের কাপড় খুলে তল্লাশির ঘটনা আবারও ঘটেছে। এবার ঘটনার শিকার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আব্বাসি সাহেব। অসুস্থ বোনকে দেখার জন্য দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত যাত্রা হলেও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর মোলাকাতের তারিখ-সময় ঠিক করে সবাইকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কাজেই না চেনা না জানার কোনো অজুহাতই সেখানে ছিল না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও মুখ বুঝে মেনে নিয়েছিলেন। নিরাপত্তা আইন নিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে বাহাস করা অপরাধের শামিল। কিন্তু বাদ সেধেছে ফেসবুক! প্রধানমন্ত্রীকে কাপড় খোলানো ও কাপড় পরানোর ছবি কোন রসিক তার মোবাইলে তুলে তা ছেড়ে দিয়েছে ফেসবুক, টুইটারে। পাকিস্তানের গণমাধ্যম এখন তাতেই তেতে উঠেছে, সে দেশের টক শোতে এখন একটাই বিষয়, ‘নাঙ্গা কি বাত’। ন্যাংটো কত প্রকার ও কী কী? কেন করল, কার দোষে এটা হলো? সারা পাকিস্তান শরমে-লজ্জায় লাল। এ রকম পতিত প্রধানমন্ত্রীকে তারা আর গ্রহণ করবে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন। দেশে ফিরলে তাঁকে আবার সীতার মতো অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয় কি না কে জানে? তবে আইন আইনই। এই যেমন বেলজিয়ামের যুবরাজকে কচলিয়ে দিল সে দেশের পার্লামেন্ট। পার্লামেন্টকে না জানিয়ে, অনুমতি না নিয়ে চীনা দূতাবাসে সামরিক পোশাকে এক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় তাঁর মাসিক ভাতা ১৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ রকম আদেশ না দেওয়ার জন্য তিনি পার্লামেন্টকে এক আবেগঘন চিঠিও লিখেছিলেন। মাসোহারা কমিয়ে দিলে তাঁর যে বড় কষ্ট হবে, তা সবিস্তারে জানিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন রাজপুত্তুরদের কষ্টের কথা। বিয়েও করতে পারেন না পার্লামেন্টকে না জানিয়ে। কিন্তু পার্লামেন্ট সেসব কথায় কান না দিয়ে তাঁকে শাস্তি দিয়েছে আইনের নিক্তিতে মেপে। তুমি যে-ই হও, আইন আইনই।

আইনের নিক্তিটা শুধু আমাদের দেশেই ইচ্ছেমতো নাড়ানো-চাড়ানো যায়। এ দেশের মানুষ তাই দাঁড়িপাল্লায় কোনো কিছু বেচাকেনার আগে ‘ফের’ ভেঙে দুই পাল্লা সমান করে নেয়। তবে অনেক ব্যবসায়ী আছেন, ‘ফের’ ভাঙতে বললে তাঁরা আগুন হয়ে ওঠেন। মরিচ খাওয়া মানুষদের নিয়ে এই এক সমস্যা। মুখ দিয়ে মরিচ খেয়ে পাকস্থলীতে পাঠানোর ব্যবস্থা হজমপ্রণালিতে চালু থাকলেও কীভাবে যেন মরিচের ঝাল সরাসরি মাথায় চলে যায়। ক্ষমতার নিচে থাকা লোকজন সামনেই এলেই মাথার সেসব ঝাল মরিচের ঘুম ভেঙে যায়। চড়াও হয় শান্তশিষ্ট, চুপচাপ অধস্তনদের ওপর।

হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ওই দৃশ্যের কথায় আসি। ওই যে মন্ত্রী, ধাক্কা দিয়ে যিনি আস্ত ইমারত ফলে দেওয়ার তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন, তাঁর সেই সাবেক মন্ত্রণালয়ের জাঁদরেল এক আমলা যাচ্ছিলেন চট্টগ্রাম। স্ক্যান মেশিনে তাঁর বাক্সপেটরা দেওয়ার পর শোরগোল করে ওঠে মেশিন। এ রকম শোরগোল করলে বাক্স খুলতে হয়। দেখাতে হয় ভয়ংকর কিছু আছে কি না। সেটাই নিয়ম—বিমানের সব যাত্রীর জন্যই একই নিয়ম। সেটাই লেখা আছে আইনে। বিমানবন্দরের পোস্টারে তা এলান করা আছে। দায়িত্বে থাকা ‘দুপয়সার কর্মীদের’ সেসব পই পই করে বলে দেওয়া হয়। দূরে বসে নিরাপত্তাকর্মীদের আচার-আচরণ, চেক করা, চেক না করা, সবই পর্যবেক্ষণ করা হয় সিসি ক্যামেরায়। কাজেই তাঁদের খাতির করা বা ছাড় দেওয়ার কোনো উপায় নেই। তবে আইন না মানার অধিকার ক্ষমতার মগডালে থাকা মানুষদের (?) একচেটিয়া। কয়েক মাস আগে এক এমপির গানম্যান গান নিয়েই ভিআইপি লাউঞ্জে থাকা তাঁর বসের কাছে কিছু একটা পৌঁছে দেওয়ার জোরাজুরি করতে দেখেছেন এক বিমানবন্দরভর্তি যাত্রী। এবার যাত্রীরা দেখলেন গণ্যমান্য আমলাটি কিছুতেই তাঁর লাগেজ খুলে দেখাবেন না। হম্বিতম্বির একশেষ! ‘দুপয়সা’ রোজে নিয়োগ পাওয়া গরিব আনসারদের এত সাহস! ব্যাগই খুলতে বলেছে। বেচারারা দেহ তল্লাশির নামে মার্কিন বিমানবন্দরের মতো কাপড় তো খুলতে বলেনি! তারপরও লাগেজওয়ালার রাগ আর পড়ে না। মারমার-কাটকাট ভঙ্গিতে ঊর্ধ্বতনদের ডেকে খাড়া করে ফেললেন নিমেষে। বেয়াদবের বিচার করতে হবে এখনই। লাগেজ খুলতে বলা গরিব আনসারদের হেফাজতে নেওয়া হলো। পরের দিনের কাগজে জানা গেল, তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে।

তবে লাগেজে কী ছিল, তা কি কেউ জানতে পেরেছেন?

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক