দোষীদের ওপর কঠোর অবরোধই চাবিকাঠি

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে মিয়ানমারের ওপর নতুন করে অবরোধ জারি করা ছাড়া রোহিঙ্গাসংক্রান্ত দাবি আদায়ের আর কোনো পথই খোলা নেই। চলমান দ্বিপক্ষীয় কিংবা ত্রিপক্ষীয় আলোচনা চলুক তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু সারকথা হলো বাংলাদেশকে এখন তাদের মিত্রদের নিয়ে জোরেশোরে মুখ খুলতে হবে। গোটা বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হলে কার্যত সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত মিয়ানমার সরকার তার পোড়ামাটি নীতি পরিহারে বাধ্য হবে। তাদের তরফে আর কোনো ধরনের মৌখিক আশ্বাস বা দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মতো বিষয়ের আলোকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসন যে সম্ভব নয়, বিশ্বকে সে বিষয়ে একমত হতে হবে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার অবশেষে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদলকে মিয়ানমার পরিদর্শন করতে দিতে রাজি হয়েছে। অনেক দিনের বিরতিতে এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। চলতি সপ্তাহে আরও একটি মাইলফলক অগ্রগতি হলো কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বিশেষ দূতের প্রতিবেদন দাখিল করা। এই প্রতিবেদনটির বিষয়বস্তু এবং সে বিষয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর যে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, তাতে আমরা মনে করি, এটি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।

অন্টারিওর মুখ্যমন্ত্রী বব রাই তঁার ওই প্রতিবেদনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছেন। প্রথমত কানাডার উচিত হবে মানবিক কারণে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশ থেকে গ্রহণ করা। শুধু গ্রহণ করাই নয়, কানাডার উচিত হবে তার মিত্রদেরও একই অবস্থান নিতে উৎসাহিত করা। দ্বিতীয়ত মিয়ানমারকে এটা বুঝিয়ে দিতে হবে যে তারা কাজটি ঠিক করেনি। অন্যথায় বব রাইয়ের কথায়, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।
আমরা মনে করি, তঁার এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বমানবতা এবং মানবতাকে যারা বিপন্ন করেছে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার সর্বজনীন অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার অনুশীলনের পথ সুগম করে দিতে দীর্ঘ অবরোধের নিগড় শিথিল করেছিল। কিন্তু আজ সময় এসেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে এটাও খতিয়ে দেখার যে তারা সেসব ক্ষেত্রে কী অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পেরেছে। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশেষ দূত গওহর রিজভী ঢাকায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ৩ এপ্রিল বলেছেন, অবরোধ তুলে নেওয়ার পরও মিয়ানমার বিশ্বকে গণহত্যা উপহার দিয়েছে। সুতরাং পুনরায় অবরোধ আরোপের বিকল্প বিশ্বকে ভাবতে হবে।

মিয়ানমারের মন্ত্রী বাংলাদেশে আসছেন, তাঁকে স্বাগত। কিন্তু তঁাদের বুঝতে হবে যে এ ধরনের কঠোর অবস্থান নেওয়া ছাড়া বাংলাদেশের আর পথ নেই। মিয়ানমারের শান্তিপ্রিয় জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের কোনো বৈরিতা নেই। অবরোধের কারণে তারা কষ্টে থাকুক, সেটাও আমাদের প্রত্যাশা নয়। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে নির্দিষ্ট অবরোধ আরোপ করে তা করতে বাধ্য করার পথ ধরতে হবে।

বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এটা পরিষ্কার করতে হবে যে শুধু রোহিঙ্গা সংকটের আলোকেই আমরা মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আশা করি না। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী অতীতে দেশটির ওপর যখন অবরোধ জারি রেখেছিল, তখন রোহিঙ্গাদের কোনো বিষয় ছিল না। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে উত্তরণের প্রশ্নই ছিল মুখ্য। সুতরাং নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদলের তদন্তের আওতায় রোহিঙ্গা সংকটের পাশাপাশি সেখানকার গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতিও বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

আমরা বিশ্বাস করি, শুধু রোহিঙ্গা সংকটকে আলাদা করে যদি দেশটির অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর তারা কী ধরনের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে সেটা খতিয়ে দেখা হয়, তাহলে দেশটির ওপর সেই কারণেও নতুন করে কঠোরভাবে অবরোধ আরোপ করাটা অপরিহার্য হয়ে পড়বে।