ধর্মে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ

নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ধর্মের মূল শিক্ষা। সব আসমানি কিতাবেই এ বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধই মানুষকে অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা করে। যার নীতিনৈতিকতা নেই, মানবিক মূল্যবোধ নেই; সে ধার্মিক হতে পারে না। কারণ ধর্মের শিক্ষাই হলো সত্যতা, সততা, পবিত্রতা।

ধর্ম মানুষের কল্যাণের জন্য এবং অকল্যাণ থেকে পরিত্রাণের জন্য। ইসলামি শরিয়তের বিধানমতে, মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য দ্বিবিধ। যথা: ‘হক্কুল্লাহ’ বা আল্লাহর প্রতি কর্তব্য এবং ‘হক্কুল ইবাদ’ বা বান্দার প্রতি করণীয়। বান্দাহ হলো আল্লাহর সৃষ্টি সব বস্তু। মানুষের প্রতি মানুষের হক বা ‘হক্কুল ইবাদ’ তথা বান্দার হক তিনটি। অর্থাৎ, প্রত্যেক মানুষের জন্য অন্য মানুষের ৩টি জিনিস সংরক্ষণ করতে হবে এবং তা এমন আমানত, যা খিয়ানত বা ক্ষতিসাধন করা সম্পূর্ণ হারাম বা নিষিদ্ধ। তা হলো সব মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান।

প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন, ‘এই মক্কা নগরী যেমন সম্মানিত, এই আরাফাতের প্রান্তর যেমন মর্যাদাবান, এই হজের দিবস যেমন ফজিলতপূর্ণ, এই কাবাঘর যেমন পবিত্র; প্রত্যেক মানুষের জান, মাল ও ইজ্জত অনুরূপ সম্মানীয় ও পবিত্র এবং তা অপরের জন্য হারাম ও নিষিদ্ধ।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।

ইসলামে মিথ্যাকে সব পাপের জননী বলা হয়েছে। প্রতারকেরা নবীজি (সা.)-এর উম্মত নয় বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। (মুসলিম: ১০১)। গিবত বা পরনিন্দাকে কোরআনে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমান বলা হয়েছে। মিথ্যা অপবাদ রটানোকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অহেতুক ধারণা করা হতে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধারণা পোষণ হতে বিরত থাকো, অনেক ধারণায় পাপ হয়। তোমরা পরচর্চা কোরো না, একে অন্যের গিবত কোরো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? অবশ্যই তোমরা তা অপছন্দ করবে। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী দয়ালু।’ (সুরা: ৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১২)।

কোনো কিছু দেখা ও শোনার ক্ষেত্রে শরিয়তের বিধান হলো; যা সরাসরি দেখা বা শোনা জায়েজ বা বৈধ, তা যেকোনো মাধ্যমে দেখা বা শোনা জায়েজ। আর যা সরাসরি দেখা বা শোনা হারাম বা নিষিদ্ধ, তা যেকোনো মাধ্যমেই দেখা বা শোনা হারাম। এখানে নৈতিকতা হলো আমি পিতা-মাতা শিক্ষক-অভিভাবক ও গুরুজনদের সামনে যা শুনছি না বা দেখছি না, তা একাকী বা ভিন্ন পরিবেশেও না দেখা বা না শোনা। কারণ আত্মগোপন করা বা লুকোচুরি করা মিথ্যারই নামান্তর।

উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিষয় বা বিবরণ অসম্পূর্ণ রাখা অথবা আংশিক পরিবর্তন করা এবং সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণ ও সত্য গোপন করা ইসলামে হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা জেনেশুনে সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ো না, আর সত্যকে গোপন কোরো না।’ (সুরা: ২ বাকারা, আয়াত: ৪২)। এর জন্য পরকালে জবাবদিহি করতে হবে।

প্রতিনিয়ত আমাদের কাছে যেসব তথ্য আসে; তার সত্যাসত্য যাচাই না করে, এর উৎস বা সূত্রের নির্ভরযোগ্যতা না জেনে, তা কখনো প্রচার করা ঠিক হবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যা শুনে তাই বলতে থাকা মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (মুসলিম)।

কারও দোষ-ত্রুটি গোপন করা বিষয়ে হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি কারও দোষ গোপন করল, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ গোপন রাখবেন।’ (তাবরানি)। তবে কারও স্বার্থ বা অধিকার রক্ষার্থে অথবা বিচারিক প্রয়োজনে এবং জাতীয় বা জনস্বার্থে প্রকাশ করা যাবে।

ইসলামের শিক্ষাই হলো নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার আমানতদারি নেই, যার কাছে নিরাপত্তা নেই, সে ইমানদার নয়। যার ওয়াদা ঠিক নেই, তার কোনো ধর্মই নেই।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১২৩২৪, বায়হাকি: ৬: ৩৮৮, ইবনে হিব্বান: ৪১: ৪৭)।

সততা হলো নিজের কাছে সৎ থাকা, নৈতিকতা হলো নিজে দায়মুক্ত থাকা; মূল্যবোধ হলো মানুষ আমার কাছে যা আশা করে তার চেয়ে ভালো কিছু করা। শত্রুর সঙ্গেও মিত্রতা করা। এর পেছনে মূল চালিকাশক্তি হলো বিশ্বাস, আশা ও ভালোবাসা। এ সবই হলো ধর্মের মূল দর্শন। একজন ইমানদার বা বিশ্বাসী মানুষ মানে একজন সৎ মানুষ, একজন উন্নত মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষই প্রকৃত ধার্মিক মানুষ। তাই প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য সততা ও পবিত্রতার চর্চা শুরু করতে হবে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]