রক্তের অক্ষরে লেখা একটি তারিখ

প্রতিটি জাতির ইতিহাসে রেড লেটার ডে বা লাল কালিতে লেখা কোনো কোনো তারিখ থাকে। রেড লেটারকে আমরা বাংলা করেছি রক্তাক্ষরে লেখা দিন। বাঙালির ইতিহাসে আক্ষরিক অর্থেই রক্তাক্ষরে লেখা একটি দিন ১০ এপ্রিল। বাঙালি এই দিনে এমন এক প্রত্যয় ঘোষণা করে, যা বদলে দেয় তার হাজার বছরের ইতিহাস।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পরবর্তী দুই সপ্তাহ বাংলাদেশের মানুষ সীমাহীন অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল। একদিকে পাশবিক শক্তির কবল থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় যার যা আছে তা–ই নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে চরম উৎকণ্ঠায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। অন্য নেতারা কে কোথায়, তা মানুষ জানত না। দেশের ভেতরের প্রচারমাধ্যম দখলদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। আকাশবাণী, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকার মাধ্যমে যে খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছিল, তাতে ভয়াবহতার চিত্র ছিল, কিন্তু দিকনির্দেশনা ছিল না। সেই পরিস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা বেতার ও আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হয় একটি অমোঘ ঘোষণা, যার ইংরেজি শিরোনাম ছিল ‘দ্য প্রক্লামেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ বা ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’।

স্বাধীনতার ঘোষণা শব্দ দুটির অর্থ কী? একটি রাষ্ট্রের মানুষের স্বাধীনতা। এ দেশের মানুষ তো রাষ্ট্রেই বাস করছিল—বন–জঙ্গলে নয়। সেখানে অফিস-আদালত, আইনকানুন সবই ছিল, যা কোনো রাষ্ট্রের থাকে। তার পরে আবার নতুন করে স্বাধীনতার প্রয়োজন কেন? সেই স্বাধীনতার জন্য ঘোষণা দেওয়ারই প্রয়োজন হলো কেন?

হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্মাবলম্বী মানুষের দেশ হলেও বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি একটি লোকায়ত জাতি দীর্ঘকাল একই রকম সুখ-দুঃখের সঙ্গে বসবাস করে, এক অভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠে কোনো জাতির মধ্যে একটি আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়। সেই জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ে পরিচিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আত্মনিয়ন্ত্রিত বা স্বশাসিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। বাঙালি জাতির সেই আকাঙ্ক্ষার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছিল একাত্তরে। সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য করতে হয়েছিল শত্রু-শাসকের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ। নিরস্ত্র শান্তিপ্রিয় এক জনগোষ্ঠীর ওপর সে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক ভয়ংকর কালরাতে। তখন কোনো বিকল্প ছিল না। খোলা ছিল একটিমাত্র পথ: হয় মুক্তি না হয় মৃত্যু বা পরাধীনতা। এ দেশের মানুষ যেকোনো মূল্যে মুক্তি ও স্বাধীনতার পথই বেছে নেয়। সে জন্য একটি আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার প্রয়োজন হয়েছিল। সেই ঘোষণাই উচ্চারিত হয়েছিল ১০ এপ্রিল ১৯৭১। সে ঘোষণাটি পাঠ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের একজন নেতাকে—অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে, তাতে প্রকাশ ঘটেছিল সমগ্র জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা।

চিরস্মরণীয় স্বাধীনতার ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘আমরা ঘোষণা দিতেছি ও প্রতিষ্ঠা করিতেছি যে বাংলাদেশ হইবে সার্বভৌম জনগণের প্রজাতন্ত্র।’ এ এক অতি অমূল্য ঘোষণা।

‘সার্বভৌম জনগণের প্রজাতন্ত্র’ কোনো কথার কথা নয়—যে রাষ্ট্রে জনগণই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়। সে কারণেই সংবিধানে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। এ কথার অর্থ হলো এই যে বাংলাদেশ কোনো কিংডম বা রাজতন্ত্র হবে না, তা হবে পিপলস রিপাবলিক—জনগণের প্রজাতন্ত্র। রাজতন্ত্রে সার্বভৌমত্ব রাজার। গণতন্ত্রে সার্বভৌমত্ব জনগণের। রাষ্ট্রে ব্যক্তির সমষ্টিকে বলা হয় জনগণ।

রাষ্ট্র হলো সমাজের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সংগঠন। সেই সংগঠন পরিচালিত হয় কিছু সুস্পষ্ট বিধিবিধান দ্বারা। সেই বিধিবিধানই সংবিধান, যা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। ‘বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ’ কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় বলা হয়েছিল:

‘এতদ্বারা নিশ্চিত করিতেছি ও সিদ্ধান্ত লইতেছি যে, সংবিধান যে সময় পর্যন্ত প্রণীত না হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপরাষ্ট্রপতি থাকিবেন।’ সেদিন গঠিত প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক কেমন হবে, তা সংবিধানে বলা আছে। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করবে, মোড়লের ভূমিকা নয়। নির্বাহী বিভাগ কতটা ক্ষমতা প্রয়োগ করবে, সে রূপরেখা বাংলাদেশের সংবিধানে দেওয়া আছে। সেই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ গর্হিত অপরাধ। প্রত্যেক নাগরিক তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগের অধিকার রাখে ভোটের মাধ্যমে শুধু নয়, দৈনন্দিন জীবনেও অবাধে মতপ্রকাশের মাধ্যমে। রাষ্ট্রের কাজ নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করা, হরণ করা নয়। সেই অধিকার খর্ব হলে তা আর জনগণের প্রজাতন্ত্র থাকে না, গোষ্ঠীবিশেষের রাজত্বে পরিণত হয় রাষ্ট্র।

মুজিবনগরের সেই ঘোষণায় অঙ্গীকার করা হয়েছিল ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত’ করার কথা। এই তিনটি জিনিসের পরে নাগরিকের আর চাওয়ার কিছু থাকে না। রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিকের সঙ্গে সমান আচরণ করবে, তা হবে তার সামাজিক অবস্থাননিরপেক্ষ। রাষ্ট্র অপরাধীকে শাস্তি দেবে, কিন্তু কস্মিনকালেও কারও মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার অধিকার রাখে না। সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্যই তো ‘সার্বভৌম জনগণের’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আরও একটি প্রতীক্ষা ছিল। ‘বাংলাদেশের জনগণকে একটি সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ানুগ সরকার দিবার জন্য যে রূপ প্রয়োজন হইবে সেই মতো কার্য করার অঙ্গীকার’। এই অঙ্গীকারের অন্য রকম প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই আমাদের ভোটের সময়। ন্যায়ানুগ সরকার একমাত্র সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ভোটের দিন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের পিটিয়ে ধাওয়া দিয়ে পুকুরে নিয়ে চুবানোর মাধ্যমে নয়।

পরাধীন দেশেরও উন্নয়ন হয়। ব্রিটিশ আমলেও হয়েছে, পাকিস্তান আমলেও হয়েছে। শিল্পকারখানা, ব্রিজ, কালভার্ট প্রভৃতি অবকাঠামোর উন্নতি আগেও হয়েছে। পাকশীতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হয়েছে, ভৈরবে ব্রিজ হয়েছে, কার্জন হল হয়েছে, কমলাপুর রেলস্টেশন হয়েছে, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, হাজার হাজার চাকমা পরিবারকে গৃহহীন করে কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প হয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের কাজও শুরু হয়েছিল, লুই কানকে নিয়োগ দিয়ে সংসদ ভবনসহ শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা করিয়ে তা বাস্তবায়নের কাজও চলছিল, কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাজও হাতে নেওয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের আগেই। অবকাঠামোর উন্নয়ন আর মানবিক মর্যাদা দুই জিনিস। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য।

সমতার বা সাম্যের কথা বলা হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। প্রত্যেক নাগরিক তার মেধা ও শক্তি বিকাশে সমান সুযোগ পাবে। যোগ্যতা অনুযায়ী
চাকরি ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। জাতিগত হোক, ধর্মীয় হোক, পেশাগত হোক, বাড়তি সুবিধা কাউকে দেওয়া যাবে না। কোটাব্যবস্থা, যে যুক্তিতেই দেওয়া হোক, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধানের অঙ্গীকারের বরখেলাপ।

রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে সপরিবার হত্যা করে সামরিক শাসন জারি, টাকা পাচার, ভিনদেশে সেকেন্ড হোম বানানো, সাধারণ মানুষের ব্যাংকে রাখা জামানত বা জলবায়ুর তহবিল খেয়ে ফেলা, নদ-নদী, পাহাড়-বনভূমি দখল, সুন্দরবনের সর্বনাশ করা; প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ বা উপাচার্যকে পেটানো বা তালাবদ্ধ করে রাখা, কর্মক্ষেত্রে ও পথেঘাটে নারীকে অপমান ও নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ প্রভৃতি বিষয়ের কথা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রচয়িতারা কল্পনাও করতে পারেননি।

৪৭ বছর পর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়নকারীদের হাজারো সালাম।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক