তরুণেরা কেন ফিরে ফিরে আসে?

কোটা প্রথায় আটকে যাওয়া বেকারের হাত আর দুই বাসের চাপায় আটকা রাজীবের কাটা হাতটাকে এক বলেই মনে হয়
কোটা প্রথায় আটকে যাওয়া বেকারের হাত আর দুই বাসের চাপায় আটকা রাজীবের কাটা হাতটাকে এক বলেই মনে হয়

প্রথমে উচ্চশিক্ষায় বাড়তি ভ্যাট আরোপের বিরুদ্ধে আর এখন সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের আন্দোলন দেখে মার্কিন সমাজতাত্ত্বিক সেইমুর মার্টিন লিপসেটের তত্ত্বটির কথা মনে পড়ে যায়, ‘আপনার দেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার থেকে ৬ হাজার ডলারের মধ্যে হলে সাবধান! এ রকম মধ্যবিত্ত অবস্থার মানুষ আঘাতের মুখে বিদ্রোহ করে। অতি দারিদ্র্য পরিবর্তনের শক্তি ও চাহিদা শুষে নেয় আবার অতিসচ্ছলতা বিপ্লব-বিদ্রোহকে দূরে সরায়। প্রতিক্রিয়া করে মধ্যবিত্তরাই।’

যারা এসব আন্দোলন করছে তারা প্রধানত উঠতি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বয়সের বিচারে সহস্রাব্দ প্রজন্ম। ছোটখাটো পারিবারিক ব্যবসা, চাকরি, কৃষি খামার বা প্রবাসী পিতার আয়ে এরা পড়ালেখা করে উঠে আসতে চাইছে। এদের কম অংশ শহুরে, বেশিটা মফস্বলি। এদের প্রত্যেকের পেছনে অপেক্ষারত পরিবার। পরিবারের পাশে সমাজ। প্রতিটি ভবনে, প্রতিটি পাড়ায় সাবালক তরুণদের সমর্থন এই আন্দোলনে আছে। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এখানে একাকার। দেখা যাচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মার খাওয়ার পর দাঁড়িয়ে থাকছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা। মহানগর থেকে গ্রামের কলেজ-সবার কথা এখানে এক। বিশেষ কোনো মতবাদের নেশায় এরা বুঁদ নয়। বহুল বন্দিত ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হওয়ার বিজ্ঞাপন দেখে তারা ভাবে, আমাদের উন্নতি তবে কই গেল? দুর্নীতি করে সফল হওয়া মানুষের জীবন এদের বুকে জ্বালা ধরায়। এরা আর তলায় পড়ে থাকতে চায় না। এদের চটালে দেশটাই চটে যাবে। এদের প্রথম জাগরণ দেখি উচ্চশিক্ষায় ভ্যাট আরোপের বিরুদ্ধে। সেটা ছিল মধ্যবিত্তের এই নতুন অংশের ওপর আঘাত।

পরিবারের সামান্য আয়কে এরা শিক্ষার মাধ্যমে অধিকতর পুঁজি আহরণে বিনিয়োগ করে। এরা ও এদের পরিবারগুলোই চলমান এলোমেলো উন্নয়নের চালিকাশক্তি। এসব পরিবার পিপীলিকার মতো সামর্থেযর চাইতে বেশি ওজন বহন করে যাচ্ছে বলে অর্থনীতি চলতে পারছে। সন্তানই এদের স্থাবর বিনিয়োগ। এই মধ্যমুখী পরিবারের প্রধান পুঁজি ‘শিক্ষা’। সেই সবেধন নীলমণিও কোটাব্যবস্থার নিগড়ে ধরা খেলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে তাদের। এ রকম অবস্থাতেই ভ্যাটবিরোধী দমকা হাওয়ার চাইতেও বড় বিক্ষোভ দেখা দিল।

ষাটের দশকের উঠতি মধ্যবিত্তের সন্তানেরাই স্রেফ বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছয় দফা আন্দোলনে এসেছিল। তারাই বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু বানিয়েছিল। এরা সুবিধা দেখলে ক্ষমতার সঙ্গে থাকে, কিন্তু বেইমানি দেখলে ছুড়ে ফেলে। এদের দমাতে গেলে সরকার পুরো সমাজের থেকে আরও নিন্দা পাবে। হারলেও এরা জিতবে, জিতলে সুযোগ-সুবিধার আরেকটু গণতন্ত্রায়ণ হবে। মুক্তিযুদ্ধে জন্ম নেওয়া দেশের সন্তান হিসেবে আত্মবিকাশের পথের কাঁটা এঁরা সরাতে চাইবেই।

তাই কোটা প্রথায় আটকে যাওয়া কোটি বেকারের হাত আর দুই বাসের চাপায় আটকা রাজীবের কাটা হাতটাকে এক বলেই মনে হয়! রাজীবের হাতটা আটকে ছিল দুই বাসের চিপায় আর চাকরিপ্রার্থীদের হাতটা আটকে আছে অন্যায্য কোটাব্যবস্থার চিপায়। প্রতিবাদী হাতগুলো এই পরিণতি চায় না। মিছিলের হাতগুলো তাই পারিবারিক দাবিনামা নিয়ে হাজির হয়েছে। রাজীবদের মতো ছেলেমেয়েরা মেসে-হোস্টেলে থেকে এই স্বপ্ন দেখে। কৈশোর শেষ হতে না-হতেই এই স্বপ্ন পরিবার তার মনে পুরে দেয়। এই লক্ষ্য সামনে রেখে তারা এসএসসি, এইচএসসি, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলসিরাত পার হয়। চাকরি ছাড়া যাদের আশা নেই, নেই পারিবারিক বড় পুঁজি বা ব্যবসা, নেই শ্বশুরের সম্পত্তির ভরসা, নেই ক্ষমতাসীন দলের নেতা হয়ে টাকা কামানোর ধান্দা, সরকারি চাকরিই তাদের জন্য হতাশার খাত থেকে উঠে আসার রশি। এই রশিটা তারা হাতছাড়া করতে চায় না। জীবন একটাই। কিন্তু সেই একবার পাওয়া জীবনের সেরা বয়সে সে দেখে কোটার ব্যারিকেড, দুর্নীতির ব্যারিকেড। সে কতটা ভেঙে পড়ে, কতটা হতাশ হয়, কতটা রাগ হয় তা ভেবে দেখেছেন? এই অভিমান জমে জমেই আন্দোলন হয়।

কোটা সংস্কারের এই আন্দোলন অভিমানের আন্দোলন। অভিমান সব সরকারের প্রতি, তোমরা কেন আমাদের জন্য এত কঠিন এক বাস্তবতা রেখে গেলে? অভিমান সিস্টেমের প্রতি, যে সিস্টেম কোটি কোটি বেকারের সামনে উন্নয়নের মুলা ঝোলালেও হাতে ধরিয়ে দেয় কচু। একদিন ভাগ্য বদলাতে তারা নেমে পড়ে। প্রথমে তারা সংবাদপত্রের দুয়ারে দুয়ারে ঘোরে। সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সঙ্গে দেখা করে মনের কষ্টটা বোঝাতে চায়। জনপ্রিয় কলামিস্টদের মেইলে অনুরোধ জানায়, তাদের হতাশার কথা যেন তাঁরা সরকারকে জানান। এভাবেই শুরু হয়। প্রথমে ৩০-৪০ জন। দিনের পর দিন তারা এখানে-ওখানে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ায়, মানববন্ধন করে। আরও অনেক আশার চাতক পাখি জমা হয়। একসময় তারা বোঝে, আন্দোলন না করলে রাষ্ট্রের কঠিন পাথরটা শুনবে না, নড়বে না।

ষড়যন্ত্র খোঁজার আগে বিক্ষোভের জোয়ারের লম্বা ইতিহাসটা জানা থাকা চাই। জানা থাকা চাই, জীবন নুইয়ে এসেছে এমন মা-বাবার দুঃখের কথা। যৌবনের সোনালি দিনগুলোতে মেসে-হলে থেকে, বাসে ঝুলে, খেয়ে না-খেয়ে চলা জীবনের গল্পগুলো শুনতে হবে। যারা মাস্তানি করে, নেশা করে, ক্ষমতাসীনদের লেঠেল যারা, তাদের এত অভিমান আসার কথা না। আজ যারা ক্ষোভে আগুন হয়েছে, তাদেরই কাঁদতে দেখেছি আগে। বেকার থাকার দিনগুলোতে কতজনের প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেছে; সেই কথা কি কাউকে বলা যায়? বলেনি। না বলে, টেবিলে মাথা গুঁজে আরও ভালো করে বিসিএস পরীক্ষার জন্য তৈরি হয়েছে। ওই সব অব্যক্ত কান্নাই গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের গৌরবের পতাকা হাতে রাজপথে নিজেকে জাহির করেছে।

তারা তৈরি করেছে প্রতিবাদের নতুন ভাষা। সেই ভাষা অহিংস, সেই ভাষা বৈষম্যবিরোধী, সেই ভাষা তরুণের উপযুক্ত স্বদেশ নির্মাণের দাবি জানায়। এই তরুণেরা উঠতি বাংলাদেশের প্রতীক। তারা শাহবাগে এসেছিল, নো ভ্যাট আন্দোলনে এসেছিল, কোটা সংস্কারের দাবিতেও তারা এসেছে। যোগাযোগপটুতা, জোট বাঁধার ইচ্ছা, আলোড়িত হওয়ার মন এই নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির তরুণ-তরুণীদেরই বেশি। গত দুই দশকে এদেরই উত্থান ঘটেছে। গ্রাম থেকে জেলা শহর হয়ে ঢাকা পর্যন্ত রাস্তা, বাস, বাসাবাড়ি, দোকানপাট, ক্রিকেটমত্ত স্টেডিয়াম ও টেলিদর্শকের সারি এদের দিয়েই ভরপুর। ভোক্তা ও ভোগান্তির বাজারেও এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ওপরতলার মানুষের থেকে এই তরুণদের মন-মগজ-মসনবি আলাদা হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। জনমত বলতেও এদের মতই বোঝায়। ভবিষ্যতে এদের আর উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না বলেই মনে হয়।

তারা অযুক্তির আবেগ নিয়ে আসেনি। অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খানের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেছেন, ‘পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের উদ্ভট কোটাব্যবস্থা নেই। বর্তমানে ২৫৮ ধরনের কোটা আছে। চাকরিতে এই কোটাব্যবস্থা অবশ্যই সংস্কার করা উচিত...এর আগে করা তিনটি কমিশনই চাকরিতে কোটা উঠিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। এর মধ্যে একটি কমিশন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আরেকটি জিয়াউর রহমান এবং আরেকটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতি কোটারই নির্দিষ্ট সীমা থাকবে। সে জন্য পাঁচ বছর পরপর কোটা পর্যালোচনা করা উচিত।’

অধ্যাপক আসিফ নজরুল লিখেছেন, ‘১৯৭২ সালের সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সম্পর্কে কিছু বলা নেই। এই সংবিধান প্রণীত হয়েছিল যে গণপরিষদে, সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাকরিতে কোটা প্রদানের কথা উত্থাপিতই হয়নি। গণপরিষদে কেবল সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের অধীনে নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান প্রসঙ্গে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ও নিহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় (বাংলাদেশ গণপরিষদের বিতর্ক, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৪৭০-১)।

দিনের শেষে রাষ্ট্র একটা যন্ত্র। এই যন্ত্রে জং ধরলে, ময়লা জমলে, নতুন সময়ের প্রয়োজন মেটাতে না পারলে তাকে সংস্কার করে নিতে হয়।

সেই দায়িত্ব সরকারের যত, জনগণেরও ততটাই। সময়ে সময়ে জনগণের বিভিন্ন অংশ তার জন্য গতি ও বেগ দুটোই দিয়ে যায়। উঠতি মধ্যবিত্তের তরুণ সন্তানেরা ইতিহাসের সেই দায়িত্বটাই পালন করছে মাত্র। একে স্বাগত।

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]