কোটা পদ্ধতির সংস্কার করুন, বিলোপ নয়

কোটা পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে আপনার বক্তব্য কী? 

আমি কোটা পদ্ধতির সংস্কার চাই।

কিন্তু আমি কোটা পদ্ধতির বিলোপ চাই না। নারী কোটা থাকতে হবে। উপজাতি কোটা থাকতে হবে। প্রতিবন্ধী কোটা থাকতে হবে। জেলা কোটা থাকাও ভালো। এটাকে বলা হয় ইতিবাচক বৈষম্য। সমাজের কোনো একটা অংশ পিছিয়ে থাকলে তাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এ ধরনের কোটা পদ্ধতির দরকার হয়। যেমন আমাদের জাতীয় সংসদের নারীদের জন্য আসন সংরক্ষিত আছে।

তবে ৫৫ শতাংশ কোটা কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা সম্মান করি, ভালোবাসি, তাঁদের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা আমরা সব সময়ই করে যাব। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই আজকে ১১ জন বাঙালি ক্রিকেট খেলে, তা না হলে আমাদের মাশরাফি বিন মুর্তজা কিংবা সাকিব আল হাসানকে আজকে পাকিস্তানের দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের জন্য পানির বোতল টানতে হতো, আজকে বাংলার জায়গায় উর্দুর চর্চা করতে হতো। কাজেই চিরজীবন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সালাম করতে হবে, তাঁদের কাছে আমাদের যে ঋণ তা কোনো কিছুর বিনিময়েও আমরা শোধ করতে পারব না।

আমার প্রস্তাব হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের ডেটাবেইস সংরক্ষণ করা হোক। প্রতিটি পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া হোক। একেক পরিবারের হয়তো একেকটা চাহিদা। কেউ চাকরি চাইবে, কেউবা ঋণ চাইবে, কেউবা ব্যবসা চাইবে, কারও হয়তো সাহায্যই দরকার নেই, কেউবা কোনো রকমের সাহায্য নিতে চাইবে না, কেউবা উল্টো সাহায্য করতে চাইবে, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার জন্য যদি কোনো ট্রাস্ট করা হয়, তাতে অনুদান দিতে পারবেন। আর সব মিলিয়ে সংরক্ষিত কোটা যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে। এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও সরকার কথা বলতে পারে। আমি জানি, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের যেন নতুন প্রজন্মের মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানো না হয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সরকারি চাকরির কোটা পদ্ধতি সংস্কার করার জন্য আপনার সুবিবেচনাপ্রসূত আশু হস্তক্ষেপ কাম্য।

২.
এর মধ্যে বহু কিছু ঘটে গেছে। কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে সারা দেশে ছাত্ররা ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে। ছাত্রদের জমায়েত ভঙ্গ করার জন্য পুলিশ অ্যাকশনে গেছে। বহু ছাত্র আহত হয়েছে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে ভয়াবহ হামলা হয়েছে। পুরো বাড়ির ভেতরটা ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। এর কোনোটাই কাম্য ছিল না।

সড়কপরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়েছে। তিনি এক মাস সময়ের মধ্যে ইতিবাচক পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছেন। ছাত্রদের একাংশ এক মাসের জন্য আন্দোলন স্থগিত করেছে। আরেক অংশ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

সর্বশেষ খবর, ছাত্ররা আন্দোলন অব্যাহতই রাখবে বলে জানিয়েছে।

ঠিক এরই মধ্যে কেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একটা মীমাংসিত বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলেন এবং নতুন বিক্ষোভ উসকে দিতে গেলেন বোঝা গেল না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ভ্যাট দিতে হবে, তাঁর এই ঘোষণা প্রকাশিত হলো সংবাদমাধ্যমে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বেরিয়ে এল রাস্তায়। ১০ এপ্রিল ২০১৮ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে বসল। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ভ্যাট দিতে হবে না।

আর সরকারি ছাত্রসংগঠনের কোনো কোনো কর্মী স্রোতের বিপরীতে শক্তি প্রদর্শনের প্রয়াস পাচ্ছেন, তা হিতে বিপরীত হচ্ছে, বিপুলসংখ্যক বিক্ষুব্ধ ছাত্রের বিক্ষোভের আগুনকে উসকে দিচ্ছে।

৩.
কোথাও যদি ধোঁয়া ওঠে, বুঝতে হবে আগুন আছে। সেই আগুন নেভাতে হবে। আজকে সারা দেশের কোটি শিক্ষার্থী যে বিক্ষোভে আন্দোলনে নেমেছে, তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে। সেই কারণ দূর না করে শক্তি প্রয়োগ করে তাদের ঘরে ফিরিয়ে নিলেই কি তাদের ক্ষোভ প্রশমিত হবে? আর বাংলাদেশের জনসংখ্যার সিংহভাগই তো তরুণ। সেই তরুণদের বিক্ষুব্ধ রেখে দেশ সামনে এগোতে পারবে? সরকার সুন্দরভাবে দেশ চালাতে পারবে? তরুণদের, ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে এগোতে হবে, তাদের সামনে আশা আর স্বপ্ন জাগিয়ে রাখতে হবে, তাদের দেশপ্রেম, কর্মস্পৃহা, ভবিষ্যৎ গড়ার উদ্যমে স্পন্দিত রাখতে হবে।

এবং সরকারকে বুঝতে হবে, জনগণ কী চায়, তরুণসমাজ কী চায়। এই তরুণসমাজ অবশ্যই স্বাধীনতার পক্ষে, মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানোর পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে। এরা যখন কোটাবিরোধী আন্দোলনে নেমেছে, তখনো এদের মুখে ছিল জয়বাংলা স্লোগান, হাতে ছিল বাংলাদেশের পতাকা, বুকের সামনে ধরা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছবি। আজকের বাংলাদেশে খুবসংখ্যক তরুণই পাওয়া যাবে, যারা পরাজিত পাকিস্তানের বাতিল হয়ে যাওয়া রাজনীতি বা মূল্যবোধের পক্ষে থাকতে পারে। কাজেই যারা কোটাবিরোধী আন্দোলনে নিয়োজিত, তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ভাবা খুবই আত্মঘাতী ভুল ভাবনা হবে।

এই ভাবনা সরকারের বিচ্ছিন্নতা বাড়াবে, যা এই সরকারের নিজের জন্যই হবে খুবই ক্ষতিকর। পাগলও নিজের ভালো বোঝে। সরকার এটা বুঝবে না কেন? ক্ষমতায় থাকলে অনেক সময় মাঠের বাস্তবতার খবর পাওয়া যায় না। বার্তাবাহকেরা সেই খবরটুকুনই কেবল দেন, যা ক্ষমতাসীনেরা শুনতে চান। এর মাধ্যমে বড় ক্ষতি হয়ে যায়।

বলপ্রয়োগ সমাধানের কোনো পথ নয়। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা করতে পারাই বুদ্ধিমানের কাজ। পলিটিকস ইজ দ্য আর্ট অব কম্প্রোমাইজ।

৪.
আমাদের সরকারি চাকরিতে অবশ্যই মেধাবীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আগামী পৃথিবীতে সম্পদ আর তেল-গ্যাস নয়, অস্ত্র আর সমরশক্তি নয়, মানবসম্পদই প্রধান সম্পদ, মেধাই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। আমাদের প্রশাসনকে পৃথিবীর সঙ্গে মেধার প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৮ সালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ।

আর বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার-এই হিসাবটা আসে আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী, মানে গত তিন মাসে চাকরি খুঁজেছেন ২৬ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। (দৈনিক যুগান্তর, ২৮ মার্চ ২০১৮)

২০১৭ সালে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, সরকারি পদ খালি আছে প্রায় ৩ লাখ। এর মধ্যে ৩৯ হাজারের মতো প্রথম শ্রেণির পদ খালি। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে, কোটার কারণেও হাজার হাজার পদে লোক নিয়োগ দেওয়া যায়নি।

এর মধ্য দিয়ে একটা বিষয় সহজেই বুঝে ওঠা যায়, কেন আমাদের শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতি সংস্কারের জন্য এমন মরিয়া। কেন তারা রাজপথে রক্ত দিচ্ছে, কিন্তু রাজপথ ছাড়তে চাইছে না।

এইখানে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে আমার একটা আবেদন আছে। দেশে যদি কর্মহীন মানুষ ৪ কোটি ৮২ লাখ হয়ে থাকে, আর গত তিন মাসে যদি ২৬ লাখ মানুষ চাকরি চেয়ে থাকে, তাহলে সরকারি চাকরির সব পদে নিয়োগ দেওয়া হলেও বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার থেকেই যাবেন। যে পদ্ধতিতেই নেওয়া হোক না কেন, সবাই সরকারি চাকরি পাবেন না।

সরকারি চাকরির পেছনে ছোটা মানে সোনার হরিণের পেছনে ছোটা। আমার পরামর্শ হলো, চাকরির পেছনে সবাই ছুটবেন না। আসুন, আমরা উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করি, ‘চাকরি করব না, চাকরি দেব’—এই হোক আমাদের স্লোগান। সারা দেশে বহু সৃজনশীল তরুণ নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করছেন, উদ্যোক্তা হচ্ছেন, নিজের ভাগ্য বদলে দিচ্ছেন, দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছেন। আপনারাই পারবেন নতুন কিছু করতে। হয় নিজে কিছু করুন, নয়তো বেসরকারি চাকরি করুন। ব্যবসা করুন। সরকারি চাকরি ছাড়াও অনেক চাকরি আছে। বেসরকারি চাকরি অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি চাকরির চেয়ে ভালো।

এবং সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বলব, বিদেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রটিতে জোর দিন। আমাদের প্রবাসী শ্রমশক্তি যেন সম্মান, নিরাপত্তা, মর্যাদা ও উপযুক্ত মূল্যায়ন পায়, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।

দেশের মধ্যে বিনিয়োগ কমে গেছে, নতুন কর্ম সৃষ্টি হচ্ছে কম, পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনের ব্যাখ্যায়ও বিশেষজ্ঞরা এই মত দিয়েছেন। এই বিষয়টাতে নজর দিন। দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করুন, বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করতে সর্বাত্মক উদ্যোগ নিন।

৬.
মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা সম্মান করব। স্বাধীনতার প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় আমরা দেব না। মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা সম্মান করব, সম্মানিত রাখব, এ বিষয়ে যেন আমাদের এক চুলও ভুল না হয়। কিন্তু কোটা পদ্ধতির সংস্কার করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের অনড় অবস্থান স্বাধীনতার পক্ষ শক্তিকেই কেবল দুর্বল করবে। এ বিষয়ে বাস্তবসম্মত সংস্কার স্বাধীনতার পক্ষশক্তিকেই শক্তিশালী করবে। লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের বক্তব্য আমি সমর্থন করি, ‘কোটা বেশি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানিত করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। কোটা একটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। কেউ যেন ব্যাপারটি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানিত করার সুযোগ না পায়।’ আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই কথাটা যেন আমরা মনে রাখি, ‘এই স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে, যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি এ দেশের মানুষ যারা আমার যুবকশ্রেণি আছে, তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক