যৌক্তিকভাবে কাজটি করতে হবে

কোটা পদ্ধতি বাতিলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে স্বাগত জানায় সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ
কোটা পদ্ধতি বাতিলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে স্বাগত জানায় সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সরকারি চাকরির জন্য ১৯৭৩ সালের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কোটা ছিল শতভাগ। মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া অন্য কারোরই এই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ ছিল না। আমি নিজে সুপিরিয়র পোস্টস এক্সামিনেশন, ১৯৭৬-এ অংশগ্রহণ করি। তখন মেধা ও বিভাগীয় কোটা ছিল ৪০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা ও মহিলা কোটা ছিল ১০ শতাংশ। সে সময় কোটার ন্যায্যতা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। এখন উঠেছে কেন, সে কথায় আসছি।

সাধারণ প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা ২৬ লাখ, যার প্রায় ১০ শতাংশ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। যারা উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে তাদের ধরলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪০ শতাংশ। জিডিপি প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও তরুণদের বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ এটাকে কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি বলেছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশের শ্রমবাজারে পাঁচ লক্ষাধিক বিদেশির অবৈধ প্রবেশ।

বিসিএস পরীক্ষা
৩৬তম বিসিএসে ২ লাখের অধিক তরুণ আবেদন করে। তার মধ্যে পিএসসি ২ হাজার ৩২৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করে। অর্থাৎ, প্রতি এক শজন প্রার্থীর মধ্যে একজন চাকরির জন নির্বাচিত হতে পেরেছে। চাকরির আবেদন থেকে যোগদান পর্যন্ত তাদের প্রায় ৩৪ মাস অপেক্ষা করতে হবে। বিভিন্ন পরীক্ষা ছাড়াও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় রয়েছে পুলিশি তদন্ত, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের বাদ দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে সরকারি পদে নিয়োগ-বাণিজ্য।

কোটার বিবর্তন
সাম্প্রতিক কালে কোটা সম্পর্কে যেসব পরিপত্র জারি করা হয়েছে, তার মধ্যে ১৯৯৭ সালের এক পরিপত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পুত্র ও কন্যার ক্ষেত্রে কোটা-সুবিধা বলবৎ করা হয়। ২০০৯ সালে ৬৪টি জেলার জন্য কোটার শতকরা হার সংশোধন করা হয়। এই হার ঢাকার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং বান্দরবানের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন শূন্য দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০১০ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য নির্ধারিত কোটা পূরণ করা সম্ভব না হলে উক্ত পদগুলো খালি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সালে জেলা কোটার পদ জেলা থেকে পূরণ করা সম্ভব না হলে জাতীয় মেধাতালিকা হতে পূরণ করার নির্দেশ জারি করা হয়। ২০১১ সালের এক পরিপত্রে উপযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী পাওয়া না গেলে তাদের পুত্র-কন্যা এবং পুত্র-কন্যার পুত্র-কন্যাকে নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়। ২০১২ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সব পদে প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের এবং কোনো সংরক্ষিত কোটায় পর্যাপ্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে তা থেকে ১ শতাংশ যোগ্য প্রতিবন্ধী প্রার্থীর দ্বারা পূরণের পরিপত্র জারি করা হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালে কোটার কোনো পদ যোগ্য প্রার্থীর অভাবে পূরণ করা সম্ভব না হলে তা মেধাতালিকার ক্রমানুসারে পূরণ করার পরিপত্র জারি করা হয়।

বিভিন্ন সময়ে আনীত সংশোধনীগুলো থেকে দেখা যায় যে কোটাকে একটা জটিল বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা সংরক্ষণ ছাড়া অন্য সংশোধনীসমূহ সুচিন্তিত নয়। এর ফলে ছাত্রছাত্রী ও চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মায় যে যোগ্যতা সত্ত্বেও সরকারি পদের জন্য তারা আর কোনো দিন নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবে না। এর ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। সর্বশেষ, কোটা পদ্ধতি বাতিলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে চলমান আন্দোলন স্থগিত করেছে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। প্রধানমন্ত্রী কোটা সম্পূর্ণভাবে তুলে দেওয়ার কথা বললেও তা সমীচীন হবে না। এটা ছাত্রদের দাবিও নয়।

সমাধানের সূত্র
৯ এপ্রিল প্রকাশিত একটি সংবাদে জনপ্রশাসনসচিবকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে কোটা সংস্কারের আপাতত ভাবনা-চিন্তা নেই। তিনি গত তিনটি বিসিএসের তথ্য তুলে ধরে বলেন, কোটায় কাঙ্ক্ষিত যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ার কারণে সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেই সব পদ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, ৩৬ তম বিসিএসে ৭০ দশমিক ৩৮ শতাংশ মেধা কোটায় নিয়োগ পেয়েছে। তাঁর কথা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে কোটায় পর্যাপ্ত যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। তা-ই যদি হয়, সেই সব কোটার শতকরা হার কমানো হচ্ছে না কেন? আবার ৭০ শতাংশ যদি মেধা কোটায় নিয়োগ পেয়ে থাকে, তাহলে মেধা কোটা ৭০ শতাংশে নির্ধারণ করতে বাধা কোথায়?

সমাধানের পথ
কোটা সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করে তাঁদের ত্যাগ ও দেশপ্রেম বিবেচনায় তাঁদের সন্তান-সন্ততি ও বংশধরদের দায়িত্ব রাষ্ট্রের-এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। চাকরিতে কোটার সুবিধা ছাড়াও তাদের জন্য আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসুবিধা, কর্মসংস্থানের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, এমনকি নগদ সহায়তাও প্রদান করতে হবে। কিন্তু বিতর্কিত কোটা অব্যাহত রেখে অসাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাধারণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো কারোরই কাম্য হতে পারে না।

আন্দোলনকারীদের দাবি পাঁচটি। এক, কোটার হার ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নির্ধারণ; দুই, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ; তিন, কোটায় কোনো সময়ে বিশেষ পরীক্ষা না নেওয়া; চার, সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করা; এবং পাঁচ, কোটার সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করা।

সরকারের সর্বশেষ সার্কুলারে দ্বিতীয় দাবিটি ইতিমধ্যে পূরণ হয়েছে বলে মনে হয়। তৃতীয় দাবিটি সম্পূর্ণ যৌক্তিক। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরে কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কাউকে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া এবং চার নম্বর দাবিতে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন মূল্যায়ন পদ্ধতি বৈষম্যমূলক এবং সম্ভবত সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ধরনের ব্যবস্থা অচিরেই বন্ধ করা প্রয়োজন। আর যে প্রেক্ষাপটে এটি করা হয়েছিল তা এখন বদলেছে। সুতরাং এ বিষয়টিও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। সর্বশেষ, কোটার সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করার দাবিটিও অত্যন্ত সংগত ও বিবেচ্য। বাকি রইল, কী কী কোটা থাকবে এবং তার হার কত হবে। যেহেতু ছাত্রদের মূল দাবি হচ্ছে মেধাভিত্তিক নিয়োগ, তাই অন্যান্য কোটাকে নিম্নবর্ণিত উপায়ে পুনর্বিন্যাস করে মেধা কোটাকে ৮০-৮৫ শতাংশে নির্ধারণ করা যেতে পারে। বিদ্যমান জেলা কোটা পুরো প্রক্রিয়াটাকেই জটিল করে ফেলেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ফলে জেলাগুলোর মধ্যে বৈষম্য কমছে, তাই জেলা কোটা তুলে দিয়ে মেধা কোটার সঙ্গে একীভূত করা যায়।

সমাজে নারীদের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে নারী কোটা পর্যায়ক্রমে কমানোর বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের অনেকেই মেধা কোটায় নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য। আবার কেউ কেউ সরকারি চাকরিতেই আগ্রহী নয়। তাই এই কোটা ৩০ শতাংশ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যেতে পারে। প্রতিবন্ধী ও আদিবাসী কোটা অক্ষুণ্ন রাখা যেতে পারে, এমনকি প্রয়োজনবোধে সামান্য বাড়ানোও যেতে পারে। তবে পুনর্নির্ধারিত সব কোটাই হতে হবে সঠিক পরিসংখ্যানভিত্তিক।

ছাত্রছাত্রীরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার আগ পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করেছে। এর একটি সুষ্ঠু সমাধান প্রত্যাশিত। কোটা সংস্কার কেবল চাকরিপ্রার্থীদের নয়, আমাদেরও দাবি। কেননা, আমাদের চাই সুশাসন। আর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সমীক্ষায় মেধাভিত্তিক নিয়োগ ও সুশাসনের ধনাত্মক সম্পর্ক সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই বাস্তবসম্মত ও ন্যায়ানুগভাবে কোটা সংস্কার করা হবে, এটাই সবার কামনা।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব ও অধ্যাপক
fouzul. [email protected]