মিয়ানমারের মন্ত্রীর সফর

মিয়ানমার ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও পদ্ধতিগত গণহত্যা চালানোর পর অবশেষে তার সমাজকল্যাণমন্ত্রীকে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে পাঠিয়েছে। মন্ত্রীর এই সফরটি বাংলাদেশের সঙ্গে একটি লোক দেখানো প্রত্যাবাসন চুক্তি করার মতো ‘অগ্রগতি’ এবং তাদের স্বার্থেই নিশ্চিত করেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। মিয়ানমারের সমাজকল্যাণমন্ত্রীর এই সফরকে কেউ হয়তো মন্দের ভালো হিসেবে উল্লেখ বা অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। যুক্তি দেখানো যেতে পারে যে, মিয়ানমার যেখানে রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক হিসেবে মানে না, সে ক্ষেত্রে তারা তাদের ফিরিয়ে নিতে একটি চুক্তি সইয়ের পর তাদের দুর্দশা দেখতে উদ্বাস্তু কেন্দ্রে আসতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু বিষয়টিকে এভাবে দেখার জোরালো যুক্তি নেই।

কারণ, মিয়ানমার শুরু থেকেই এ ব্যাপারে নানা কৌশল নিয়ে যাচ্ছে এবং রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাদের দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রীয় নীতির পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। সারা বিশ্বে এতটা ধিক্কার, হইচই পড়ার পরও মিয়ানমারের ‘গণতান্ত্রিক নেত্রী’ অং সান সু চি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ কোনো উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনে যাননি। আর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শেষে বুলডোজার দিয়ে ধ্বংসচিহ্ন নিশ্চিহ্ন করারও অনেক পর সমাজকল্যাণমন্ত্রীকে পাঠানোর মধ্যেও কৌশলগত দুরভিসন্ধি থাকার আশঙ্কা নাকচ করা যাবে না। বিষয়টিকে এখন কেবলই একটি মানবিক আবেদনে সাড়া হিসেবে দেখতে চায়। তারা গুরুত্বপূর্ণ কোনো মন্ত্রীকে পাঠিয়ে রোহিঙ্গাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চায় না। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের শিবির পরিদর্শনে গিয়ে মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। এই সফরটিকে যান্ত্রিক এবং কূটকৌশলগত সফর ছাড়া অন্য কোনোভাবে মূল্যায়ন করার তেমন অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।

আমরা দেখলাম মিয়ানমারের মন্ত্রীর সফরের পর বান্দরবান সীমান্তের শূন্যরেখার শিবিরে আশ্রয় নেওয়া পাঁচ সদস্যের এক রোহিঙ্গা পরিবারের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়াকে মিয়ানমার সরকার ‘প্রত্যাবাসন’ হিসেবে প্রচার-প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটি চুক্তি করলেও তা বাস্তবায়নে তারা অব্যাহতভাবে গড়িমসি করে চলেছে।

তবে শরণার্থী প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ উদ্বাস্তু হাইকমিশনের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। প্রত্যাবাসন শুরু করার মতো অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সামনে বর্ষা মৌসুমে উদ্বাস্তুদের কষ্টক্লিষ্ট জীবনে দুর্ভোগ আরও বহু গুণে বৃদ্ধি পাবে। আর আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়ার যে ঝুঁকি, সেটা আরও দিন হেলাফেলায় গড়াতে দিলেই দূর হয়ে যাবে—তেমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু জাতিসংঘ, তার অঙ্গসংগঠনগুলো, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন পর্যন্ত মিয়ানমারকে কোনো একটি সঠিক সিদ্ধান্তও মানতে বাধ্য করাতে পারেনি। বরং চুক্তি, আলোচনা, দ্বিপক্ষীয় সফরের মতো কিছু বিষয় ধীরে ধীরে সমস্যাটির ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নজর সরিয়ে নিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে তারা হয়তো বিস্মৃতির আড়ালে চাপা পড়া একটি রাষ্ট্রবিহীন উদ্বাস্তু গোষ্ঠীতে পরিণত হবে।

মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপে বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সাঁড়াশি কূটনীতিতে নেমে পড়তে হবে। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করি, বাংলাদেশ এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে যারা বিশ্বশান্তির জন্য অপরিহার্য মনে করে, সেসব দেশও মাঝেমধ্যে কিছু ‘কঠোর বাণী’ কিংবা অকার্যকর বলে প্রমাণিত হওয়া সীমিত অবরোধের মতো কর্মসূচি পালনের মধ্যে তাদের কার্যক্রমকে আবদ্ধ রাখছে। বাংলাদেশ সম্প্রতি তার যেসব মিত্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অত্যন্ত উঁচুতে নিয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে নিয়ে তাকে দেশটির সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারকে রোহিঙ্গাদের নিজ নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করার কূটনীতিতে সক্রিয় হতে হবে।