কোটাবিরোধী আন্দোলনের গোড়া যেখানে

কোটার আন্দোলন নিয়ে সরকারি দলের নেতাদের কেউ কেউ যে মন্তব্য করেছেন, তা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আত্মসম্মানে আঘাত হেনেছে
কোটার আন্দোলন নিয়ে সরকারি দলের নেতাদের কেউ কেউ যে মন্তব্য করেছেন, তা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আত্মসম্মানে আঘাত হেনেছে

আধুনিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও শ্রেণি-পেশার মানুষের হাজারো সমস্যা ও দাবিদাওয়া থাকাই স্বাভাবিক। তার কিছু ন্যায্য, কিছু নয়। মানুষের সংক্ষুব্ধতা প্রশমনের পথ দুটি: যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে-শুনিয়ে শান্ত করা অথবা শক্তি প্রয়োগ করে দমন করা। শান্তিপূর্ণ সমাধানই উত্তম পথ এবং তাতেই সরকার প্রশংসিত হয়। তাতেই সমাজের কল্যাণ।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চাকরিতে নিয়োগ প্রভৃতিতে কোটা নিয়ে কথাবার্তা নতুন নয়। অনেক বছর ধরে এই ব্যবস্থা সংশোধনের জন্য শিক্ষার্থীরা দাবি করছিলেন। প্রথমে তাঁরা পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেছেন, সংবাদ সম্মেলন করেছেন, মানববন্ধন করেছেন, শহীদ মিনারে সভাও করেছেন। এ বছরের শুরু থেকেই কোটা সংশোধনের দাবিতে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ ব্যানারে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছিল। গত সপ্তাহে তাঁরা ঢাকার শাহবাগে অবস্থান নিয়ে ঘোষণা করেন, ‘দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত’ কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন।

জনগণের কোনো অংশে কোনো দাবি উচ্চারিত হলে তা শোনা এবং তা ন্যায্য কি অসংগত, তা বিবেচনা করা সরকারের কর্তব্য। আমি যদি সরকারের নীতিনির্ধারক বা সাংসদদের একজন হতাম তাহলে শিক্ষার্থীদের ওই ঘোষণার কথা কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শাহবাগে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতাম। তাঁদের বুঝিয়ে বলতাম, আপনারা কোনো রকম উগ্র পন্থা বেছে নেবেন না। আমরা আপনাদের দাবি পর্যালোচনা করে দেখব। ন্যায়সংগতভাবে এর সমাধান কীভাবে করা যায়, সে চেষ্টা করা হবে।

আমার বিশ্বাস, শিক্ষার্থীরা সে পরামর্শ শুনতেন।

মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত বঙ্গীয় জনপ্রতিনিধিদের কাজটা কী, তা আমি যখন জানি না তখন দেশের ৫১ ভাগ মানুষের জানার কথা নয়। বিক্ষুব্ধ যেকোনো সম্প্রদায়কে শান্ত করার প্রধান উপায় হলো সহানুভূতির সঙ্গে তাদের কথা শোনা। শুনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। ওই পথে না গিয়ে রাতে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত বিবেচনাপ্রসূত হয়নি। যেকোনো সমাবেশে উগ্রপন্থী উপদল থাকা অস্বাভাবিক নয়। পুলিশের মারের পর একদল শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে সংঘাত শুরু করেন। বিভিন্ন হল থেকে মেয়েরাও নেমে আসেন রাস্তায়।

যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র রয়েছে, সেখানে জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয় নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা হয়। পার্লামেন্টে বিভিন্ন দলের যেমন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত থাকে, দলীয়-নির্দলীয় প্রত্যেক এমপির নিজস্ব মতামতও থাকা স্বাভাবিক। কোটা সংশোধনের প্রশ্নে আমাদের সাড়ে তিন শ সাংসদের কার কী মতামত, তা শিক্ষার্থীরা জানতে পারলেন না। এতে প্রমাণিত হয় বিষয়টি নিয়ে তাঁরা ভাববার প্রয়োজন বোধ করেননি। এলাকার স্কুল-কলেজের চেয়ারম্যান বা অভিভাবক হয়ে খবরদারি করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকা দোষের নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ-বাণিজ্যে পৌরোহিত্য করা নিয়েও কারও আপত্তি নেই, কিন্তু জনপ্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু মাথা ঘামাবেন না, তা বড়ই দুঃখজনক।

সব সরকারের সময় বাংলাদেশে সরকারি দলপন্থী অথবা সরকারের সুবিধাভোগী শিক্ষাবিদেরা উঁচু পদে নিয়োগ পেয়ে ধন্য হন। কোটা নিয়ে অনেক দিন থেকে কথাবার্তা হচ্ছে, কিন্তু তাঁরা শিক্ষার্থীদের সমর্থনে কোনো মতামত দিয়েছেন, তেমন কোনো প্রমাণ নেই। যখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করলেন, তাঁরা কেউ বললেন ‘দাবি যৌক্তিক’, কেউ শিক্ষার্থীদের সুরে সুর মিলিয়ে বললেন, ‘কোটা ১০ শতাংশ করাই উচিত।’ বলা যায়, এ ধরনের সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ লইয়া সরকার কী করিবে?

জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া ১৫ বছর সরকারে ছিলেন। তাঁদের সরকার কোটাব্যবস্থা সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এখন আন্দোলন যখন বেকায়দা আকার ধারণ করল তখন বিএনপি থেকে তাঁরা শিক্ষার্থীদের সমর্থন করে বিবৃতি দিলেন। বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ বিএনপির প্রাত্যহিক সান্ধ্য-বিবৃতি। বাংলা গদ্যে তা যোগ করেছে এক নতুন মাত্রা। তিনবার ক্ষমতায় থাকা দলের নেতাদের দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। উপাচার্যের বাসভবনে ভাঙচুরের জন্য একটি নিন্দাসূচক কথাও তাঁদের কলম ও মুখ দিয়ে বের হলো না। উপাচার্যের বাসভবন আওয়ামী লীগের সম্পত্তি নয়।

দাবি ন্যায়সংগত হতে পারে, তা আদায়ের জন্য আন্দোলন সহিংস হবে কেন? মধ্যরাতে উপাচার্যের বাসভবনে হামলা, ভাঙচুর ও মারধর অতি নিন্দনীয় কাজ। তার সঙ্গে যারাই জড়িত থাক, বহিরাগত দুষ্কৃতকারীরাও থাকতে পারে, তাদের শনাক্ত করে বিচার করা প্রশাসনের দায়িত্ব। কিন্তু অপরাধী ছাড়া যদি একজনও নিরপরাধ শিক্ষার্থী মামলা-মোকদ্দমার হয়রানিতে পড়েন, তাহলে সেটা হবে রাষ্ট্রের দিক থেকে অন্যায়।

কোটার আন্দোলন নিয়ে সরকারি নেতাদের কেউ কেউ যে মন্তব্য করেছেন, তা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আত্মসম্মানে আঘাত হেনেছে। তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বাঙালি সৃষ্টিশীল জাতি। ভাষার ওপর প্রতিটি বাঙালির অসামান্য দখল। আন্দোলনকারীদের হাতে লেখা প্ল্যাকার্ডে এবং স্লোগানে তাঁদের আবেগ ও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে। সেদিনের প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুনের ভাষা ও বক্তব্য সরকারি দলের নেতাদের বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত নিজেদের স্বার্থেই।

কোটা নিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন আন্দোলন করছেন, তখনই দৈববাণীর মতো ঘোষিত হলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ভ্যাট দিতে হবে। সংক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তখন খেপে যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনও। যা হোক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণায় শুরুতেই বিষয়টি থেমে যায়, তা না হলে আন্দোলনে যোগ হতো নতুন মাত্রা।

সোমবারও ঢাকা ও বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়। আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধিদল সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সচিবালয়ে বৈঠক করার পর আন্দোলন এক মাসের জন্য স্থগিত হওয়ার কথা শোনা যায়। সেটাই ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু একটি অংশ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ঠিক একই অবস্থা হয়েছিল শাপলা চত্বরে হেফাজতের সরকার পতনের বিপ্লব ঘটানোর সময়। রাতারাতি সব দাবি আদায় হয় না। এবং চাপ দিয়ে আদায় করলেও তার ফল ভালো হয় না। তাঁরা যে পাঁচ দফা দাবি করেছেন, তার অধিকাংশই ন্যায়সংগত।

কোটাব্যবস্থা সংশোধনের কথা যাঁরা বলছেন এবং তাঁদের যাঁরা সমর্থন দিচ্ছেন, তাঁরা আরও ভালো প্রস্তাব দেননি। যেমন জেলা কোটার একসময় যৌক্তিকতা ছিল। দেশের কোনো কোনো অঞ্চল একসময় শিক্ষা ও চাকরিবাকরিতে পিছিয়ে ছিল। ১৫-২০ বছর ধরে সে অবস্থা আর নেই। আহত ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানজনক জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সে দায়িত্ববোধ থেকেই ১৯৭২-এ পুলিশ, বিডিআর, আনসার, সেনাবাহিনী প্রভৃতি বিভাগে তাদের ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত রাখা হয়। ভুয়া নয়, সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের শুধু চাকরি দেওয়াই যথেষ্ট নয়, তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য করতে খুব কম সুদে ব্যাংকঋণ দেওয়ার বিষয়টিও ভাবা যায়।

শুধু কোটা বাতিল বা সংশোধন করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যা গভীরে। গত ১৬ জানুয়ারি জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জাতীয় সংসদে বলেন, সরকারি চাকরিতে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ২৬১টি পদ খালি আছে। তার মধ্যে ৪৮ হাজার ২৪৬টি প্রথম শ্রেণির, ৫৪ হাজার ২৯৪টি দ্বিতীয় শ্রেণির। দেশে শিক্ষিত বেকার যুবকের সংখ্যা ২৫ লাখের বেশি। এখনকার যুবসমাজই ১০-১২ বছর পরে দেশের নেতৃত্ব দেবে। তাদের মনস্তত্ত্ব নীতিনির্ধারকদের পাঠ করতে হবে। সরকারের সক্ষমতাও সীমিত। ভাবাবেগপ্রসূত দাবিদাওয়া ও তার জন্য আন্দোলনের যেমন মূল্য নেই, তেমনি অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তও কল্যাণ বয়ে আনে না। দেশের বাস্তবতা বিবেচনা করে সব পক্ষকেই দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক