নতুন সমস্যা: 'ভাগালু' মিলছে না

এবার হাওরে ধানকাটা শ্রমিকের বেশ সংকট
এবার হাওরে ধানকাটা শ্রমিকের বেশ সংকট

এখন পর্যন্ত হাওরের খবর ভালো। ঢল নামেনি অসময়ে। গত বছরের মার্চের শেষ সপ্তাহে, চৈত্রের মাঝামাঝি স্মরণকালের সবচেয়ে সর্বনাশা ঢলে হাওরের ধান শেষ হয়ে যায়। মাছ মরে, হাঁস মরে; লাখে লাখে, হাজারে হাজারে। অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে অজানা-অচেনা শহরে পাড়ি জমান রুটিরুজির সন্ধানে। সবাই কি ফিরে আসতে পেরেছেন তাঁদের জমিনে, ভিটায়, চাষের জমিতে? আন্দোলন হয়েছিল-অন্তত একটা বছর হাওরের মানুষকে হাওরের জলে মাছ ধরার অধিকার দেওয়া হোক-ভাসান জলে তাঁরা মাছ ধরবেন। সংরক্ষিত জলমহালে যাবেন না। হাওরসন্তান রাষ্ট্রপতি ছুটে গিয়েছিলেন, কথা দিয়েছিলেন বিবেচনার। বিবেচিত হয়নি সেই আরজি। মানবিক সংস্থাগুলো দ্বিতীয় দফা রিলিফ দিতে গিয়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ প্রান্তিক মানুষকে খুঁজে পায়নি। যাদের পাওয়া গিয়েছিল, তারাও ভাঙা পরিবার-পরিবারপ্রধান কর্মক্ষম মা-বাবা, ভাইবোন চলে গেছেন কাজের খোঁজে। প্রবীণ আর শিশুরা পড়ে ছিল ভিটায় সুদিনের অপেক্ষায়। অনেক মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষার্থীরা আর ফেরেনি। হাওরের অনেকেই প্রাণঘাতী ঝুঁকির কাজ করতে পাথর কোয়ারিতে যোগ দেন। পাথর কোয়ারির দখলদারেরা সেই সুযোগে কমিয়ে দেন মজুরি। দুর্গম-পরিত্যক্ত গর্তগুলোতে লাগান নিরুপায় শ্রমিকদের। নিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থা না থাকায় প্রাণনাশী দুর্ঘটনা এবার বেড়ে যায় ব্যাপক হারে। ১২-১৩ বছরের শিশুসহ এবার এ কাজে নিহত হয় প্রায় দেড় শ জন। বাংলা টিলায় এক দিনে নিহত হয় সাতজন। গভীর গর্তে চাপা পড়া আরও দুজনের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। একই পরিবারের ছেলেমেয়ে, মা-বাবাসহ একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। অকালবন্যার শিকার মানুষদের আরও অনেক নির্মম পরিণতি মেনে নিতে হয়।

আগাম বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে এবার জোরেশোরে ব্রি-২৮ জাতের ধান চাষের পক্ষে মানুষকে উৎসাহিত করা হয়। যাঁর বেশি জমি আছে, তিনি ভাগাভাগি করে ব্রি-২৮ আর ব্রি-২৯-এর চাষ করেছেন। একটু উঁচু জমিতে ব্রি-২৯ লাগিয়েছেন আর নিচু জমিতে লাগিয়েছেন ব্রি-২৮। ব্রি-২৮ প্রায় দুই সপ্তাহ আগে কাটা যায়। মার্চের শেষে বা এপ্রিলের প্রথমে এই ধান ঘরে তোলা যায়, কিন্তু ব্রি-২৯ পাকতে পাকতে এপ্রিল প্রায় শেষ হয়ে যায়। গত দুই বছরের ফসলহানির কথা ভেবে বেশির ভাগ ছোট চাষি আর বর্গাচাষি ব্রি-২৮-এর চাষে মন দেন। এই ধান আগে কাটা গেলেও ফলন কম। এক হেক্টরে মেরেকেটে ছয় টন। এই ধানের গাছও একটু খাটো হয়। অন্যদিকে ব্রি-২৯-এর হেক্টরপ্রতি ফলন হয় দেড়-দুই টন বেশি। তারপরও এবার মানুষ অনিশ্চয়তার ঝুঁকি না নিয়ে কম ফলনের ব্রি-২৮ মেনে নিয়েছিল। ফসল রক্ষার বাঁধ সময়মতো তৈরির তোড়জোড় বিতর্ক, পুকুরচুরি, সাগরচুরি, মন্ত্রী বদল, সচিব বদলি-সবই ঘটেছে গত ছয় মাসে। সব বাঁধ শক্তপোক্ত করে সব জায়গায় সময়মতো হয়েছে বলে কেউই এখন পর্যন্ত সাদা সনদ দিতে পারেনি। তবে মানুষ অনেক সতর্ক ছিল। গত-নবাগত উভয় মন্ত্রীর দৃশ্যমান ছোটাছুটি ছিল। বলা যায়, বেশির ভাগ জায়গায় বাঁধের কাজ প্রায় সময়মতো শেষ হয়েছিল। তবে কাজের মান পরীক্ষার পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি, সেটাই মূল কথা। উজানের ঢল নামেনি। আসাম, মেঘালয়ে আগাম বর্ষা শুরু হলে বোঝা যেত বাঁধগুলো কেমন টেকসই হয়েছে।

প্রকৃতির এই আনুকূল্য কৃষকদের মনে আশার সঞ্চার করলেও এবার সংকট উঁকি দিচ্ছে অন্যদিকে। হাওরে এবার শ্রমিকের সংকট। এমন সংকট নিকট অতীতে হয়নি। হাওরের ধান কাটার জন্য গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম প্রভৃতি জেলা থেকে দিনমজুরদের সমাগম ঘটত। এবার তাঁদের সংখ্যা একেবারেই কম। এসব মৌসুমি শ্রমিককে কোথাও কামলা, কোথাও ভাগালু কিংবা মজদুর নামে ডাকা হয়। বেশির ভাগ ধান কাটার শ্রমিক পারিশ্রমিক হিসেবে আগে ধানের ভাগ নিতেন-এ কারণে নেত্রকোনার হাওর অঞ্চলে তাঁদের ভাগালু বলা হয়। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও ধানের ভাগ নিয়ে নৌকায় করে এসব শ্রমিকের বাড়ি ফেরার কথা আছে। ধান পরিবহনের খরচ বেড়ে যাওয়া আর বেহাল রাস্তাঘাটের কারণে এবার ধানের ভাগ না নিয়ে নগদ টাকা চাইছেন শ্রমিকেরা। প্রতিদিনের জন্য ৫০০-৬০০ টাকা। দুবার ফসল মার যাওয়ায় হাওরের চাষিদের হাতে নগদ টাকা একেবারেই নেই। তাই শ্রমিক সংগ্রহ তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। বাইরের জেলা থেকে শ্রমিক সংগ্রহের জন্য চাষিদের নির্ভর করতে হয় ব্যাপারীদের ওপর। সেখানেও তাঁদের মাথাপিছু অগ্রিম টাকা দিতে হয়। নগদ টাকায়। নগদের টানাটানি কি শ্রমিকসংকটের একমাত্র কারণ? সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা আর জামালপুরের শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা অন্য আরও কিছু কারণের কথা বললেন।

এক. আগে ধান পাকার কথা তাঁদের জানা ছিল না। অর্থাৎ এবার ব্রি-২৮ ধান চাষের কথা কেউ তাঁদের জানায়নি। আর জানালেও তিন সপ্তাহ আগে যেতে গেলে হাতের কাজ গুছিয়ে (যেখানে তাঁরা শ্রম দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ) যেতে পারতেন না। বেশির ভাগ মানুষই এখন অনেক আগেই তাঁদের কাজের জায়গা আর সময় চূড়ান্ত করে ফেলেন।

দুই. কাজের খোঁজে পরপর দুই বছর হাওরে গিয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছেন অনেকে। এবার আর ঝুঁকি নিতে মন চায়নি। অন্য কাজ জুটিয়ে নিয়েছেন।

তিন. হাওরের সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হওয়ায় তাঁরা তাঁদের ঘরগুলো মেরামত করতে পারেননি। ফলে বাইরের শ্রমিকদের রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা এবার অনেক জায়গায় করতে পারছেন না। খালিয়াজুরির পুরানহাটি গ্রামের শফিক মিয়া অনেক কষ্টে পাবনা থেকে কিছু শ্রমিক সংগ্রহ করে এনেছেন থাকার ভালো ব্যবস্থার শর্তে। নিজেদের বসতঘর ছেড়ে দিয়েছেন পাবনা থেকে আনা ‘ভাগালুদের’ জন্য। তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকছেন প্রতিবেশীর সঙ্গে।

চার. জামালপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জের অনেকেই জানালেন, রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় ট্রাকের ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে। তা ছাড়া সময়ও লাগছে অনেক বেশি। কাজেই মজুরি হিসেবে ধান নিলে তাঁদের পড়তা পড়বে না, তাই তাঁরা যাচ্ছেন না। নগদ টাকা দিলে তাঁরা যেতে রাজি।

পাঁচ. স্থানীয় শ্রমিকদের একটা বড় অংশ পাথর উত্তোলনে নিয়োজিত হচ্ছেন। বর্ষাকালে সেই কাজ কমে যায়। এখন কাজ প্রচুর, তাই ধান কাটার কাজে তাঁদের আনতে হলে মজুরি বাড়িয়ে দিতে হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা ধান পাকার সঙ্গে সঙ্গে ধান কেটে ফেলার জন্য তাগিদ দিচ্ছেন বারবার। যেন ঢল নামার আগেই ফসল ঘরে উঠে আসে। শ্রমিকের ঘাটতি দূর করার জন্য সুনামগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ধান সংগ্রহের আধুনিক যন্ত্রপাতি আনার কথা সংবাদমাধ্যমকে অবহিত করেছে। রিপার, কম্বাইন্ড হারভেস্টর, মিনি হারভেস্টর প্রভৃতি স্বয়ংক্রিয় মেশিন ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষকদের দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।

বছরখানেক আগে অর্থমন্ত্রী একদল কর্মকর্তা নিয়ে বেলারুশিয়া সফরের সময়ও এ রকম কথা শোনা গিয়েছিল। বেলারুশ সরকারের সঙ্গে এসব নিয়ে সমঝোতা স্মারকের কথাও তখন শোনা গিয়েছিল। সেই স্মারক এখন কোন সড়কে আছে কে জানে। হাতে এখন মাত্র তিন সপ্তাহ সময়। ধান কেটে ঘরে তুলতে হবে, কৃষককে নগদ অর্থের স্বল্পমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা একটা সমাধান হতে পারে। মজুরি হিসেবে পাওয়া ধান বাড়ি নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও শ্রমিকদের সহায়তার আশ্বাস দিতে পারে সরকার, প্রশাসন। গণমাধ্যমে শ্রমিকের চাহিদা আর মজুরির কথা প্রতিদিন জানানো যেতে পারে। এক দিন, দুই দিন রেল-বাস ফ্রি করে দিয়ে শ্রমিকদের নিরাপদ গমনাগমন নিশ্চিত করলে আখেরে দেশের লাভ। সরকারেরও লাভ।

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক