উত্তমর্ণ বেলাল ভাই

বেলাল চৌধুরী
বেলাল চৌধুরী

তখন আমি ‘কবিতার কামড়ে অস্থির যুবা’, কিশোরীর প্রথম স্তনাভাসের ব্রীড়া নয়, আমার ভেতরে কাজ করছে প্রকাশের নিদারুণ তাড়না আর বেদনা। পড়ি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে, কারফিউ-কাতর রাতে হলুদ সোডিয়াম আলোকস্তম্ভ কিংবা চাঁদের মিহি রেণু মাথার অবিন্যস্ত চুলে মাখতে মাখতে একা একা হেঁটে যাই কবি আর কবিতার সন্ধানে। মেডিকেল ইন্টার্নি হোস্টেলে থাকেন মিনার মনসুর, বুয়েটের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য বানানো এক বাথরুমের টানা টিনশেড কলোনিতে থাকেন নির্মলেন্দু গুণ, আজিমপুর চায়না বিল্ডিংয়ের গলিতে মহাদেব সাহা, কাছেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে হুমায়ুন আজাদ। তাঁদের কাছে যাই, শীতের সকালে লেপের মধ্যে থেকে দুটো হাত বাড়িয়ে নির্মলেন্দু গুণ বলেন, মিটুন, আইছ, বসো। মহাদেবদার বাসায় তাঁর দুই ছেলে তীর্থ আর সৌধ মিটুনকাকু বলে শার্টের আস্তিন ধরে ঝুলে পড়ে, নীলা বউদি মাগুর মাছের অতি পাতলা ঝোল দিয়ে গরম ভাত খেতে দেন। আর কোনো কারণে টাকাপয়সা ইত্যাদির দরকার পড়লেই চলে যাই গ্রীন সুপার মার্কেটের পেছনে, শহীদুল্লাহ অ্যাসোসিয়েটসে, কবি রবিউল হুসাইনের কাছে, কবি এবং স্থপতি, রবিউল ভাই, স্মরণিকা বের করব, চাঁদা দেন। বুয়েটের ছাত্র, আমাদের অধিকার আছে রবিউল ভাইয়ের কাছে। কিন্তু কেন যেতাম ধানমন্ডি ২ নম্বর সড়কে ভারতীয় হাইকমিশনের অফিসে, কবি বেলাল চৌধুরীর কাছে? এত ছোট একজন মানুষ আমি, ওজন তখনো ৫০ কেজি, মাথার চুল উষ্কখুষ্ক, চোখের নিচে কালো ছায়া, গায়ে অতি অবশ্যই জিনসের শার্ট, হাতা গোটানো, পায়ে কেডস। বেলাল ভাই বসতে দিতেন। চা খেতে দিতেন। আর ‘ভারত বিচিত্রা’য় কবিতা প্রকাশ করতেন। আর?

যত দাবি তাঁর কাছেই। কারও ইন্ডিয়ান ভিসা লাগবে, পাসপোর্টটা তাঁর হাতে দিলেই হলো। আর স্মরণিকার জন্য বিজ্ঞাপন। তিনি ফোন করে দেবেন। আর? লুনা ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়, বেলাল ভাই কী করা যায়? বেলাল ভাই বললেন, রবীন্দ্রভারতীতে যাক, স্কলারশিপ নিয়ে। এখন ভাবি, আচ্ছা, বুয়েটের একটা ছাত্র, শুধু কবিতা লিখতে চায়, এ ছাড়া যার আর কোনো যোগ্যতা নাই, পরিচয়ও নাই, তাকে এত বড় মানুষটা বসতে দিতেন কেন, চা খাওয়াতেন কেন, আর তার জুলুমগুলো সহ্য করতেন কেন।

আহা, আমাদের বেলাল ভাই। আমার টেবিলে দুটো বই, এখনো পড়ে আছে, মাঝেমধ্যেই কাজে লাগে—‘ওয়ার্ল্ডস, সেভেন মডার্ন পোয়েটস’ আর ‘গুন্টার গ্রাস’। আমি জানি, বই দুটোর আসল মালিক বেলাল ভাই। বিশ্বসাহিত্যের মনোযোগী পাঠক ছিলেন তিনি।

সেদিন কবি পিয়াস মজিদ বললেন, বেলাল চৌধুরীকে লেখা চিঠির বই বেরিয়েছে, আপনার একটা চিঠিও আছে। আমি বলি, হতেই পারে না। তিনি বললেন, আমি ছেপেছি, আমি জানি। আমি বললাম, অন্য কোনো আনিসুল হক হবে হয়তো। বইটা বইমেলা থেকে কিনে ফেললাম। দেখি, সত্যি সত্যি আমার একটা চিঠি, আমার হাতের লেখাসমতে ছাপা হয়েছে। বেলাল ভাই একটা সময় আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয় ছিলেন।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীরও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বেলাল ভাই। আমি জানতাম। ওর প্রথম দিকের কাজ, ‘আয়েশামঙ্গল’ কিংবা ‘ভোকাট্টা’র প্রিমিয়ার শো ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে হতো আর বেলাল ভাই সেখানে উপস্থিত থাকতেন।

বেলাল ভাইয়ের লেখা আমাকে নিয়মিত পড়তে হতো সম্পাদক হিসেবে। আমি তো খবরের কাগজ, কাগজ এই সব পত্রিকায় কাজ করতাম, বেলাল চৌধুরী নিয়মিত লিখতেন। তিনি ছিলেন আমাদের সবচেয়ে ভালো ফিচার লেখকদের একজন।

গুন্টার গ্রাস বাংলাদেশে এসেছিলেন, তাঁকে সঙ্গ দিতেন বেলাল ভাই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়দের বন্ধু ছিলেন। সুনীল গাঙ্গুলি ঢাকা এলে আমরাও নেমন্তন্ন পেতাম, গাজী ভবনে, ভালো পানাহারের ব্যবস্থা থাকত, একবার আস্ত আস্ত রুপচাঁদা মাছ ভাজা খেয়েছিলাম। রবিউল হুসাইন, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, হাবীবুল্লাহ সিরাজী ভাইরা ছিলেন একটা জোট মতন। তারাপদ রায় একবার একটা বই লিখলেন—‘দুই মাতালের গল্প’—সেটা উৎসর্গ করার জন্য পশ্চিম বাংলায় কাউকে পাননি, পেয়েছিলেন পূর্ব বাংলায়, বেলাল চৌধুরী আর রফিক আজাদকে।

একদিন, বছর দুয়েক আগে, কোনো এক টিভি চ্যানেলে গেছি। টক শো। সাহিত্য নিয়েই। বেলাল ভাই আর আমি আলোচক। বেলাল ভাইয়ের পরনে একটা সুতির হাফশার্ট, মনে হয় ওইটা পরেই ঘুমিয়েছিলেন, ওটা পরেই চলে এসেছেন, সেই শার্টের কলার দোমড়ানো-মোচড়ানো, পকেট লেপটে যাওয়া—আমি হাঁ হয়ে দেখছি তাঁকে, দেবদূতের মতো কান্তি, সাদা-পাকা চুল, ব্যাকব্রাশ করা, বড় বড় চোখ, কিন্তু পুরোই আত্মভোলা একজন মানুষের প্রতিকৃতি যেন।

বেলাল ভাই হাসপাতালে, দেখতে যাওয়া হয় না। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে ফোন করি, ওই মিয়া, বেলাল ভাইকে দেখতে গেছ? রবিউল ভাইকে ফোন করি। রবিউল ভাই, বেলাল ভাই কেমন আছেন। তারপর সাহস সঞ্চয় করে হাসপাতালে যাই। আইসিইউয়ের ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলি। বেলাল ভাইয়ের আমেরিকা থেকে আসা কন্যা মৌরির সঙ্গে কথা বলি। ডাক্তাররা বলেন, দেখতে যাবেন, ভেতরে চলেন।

আমি বলি, না।

বেলাল ভাইয়ের ফটো দেখেছি ফেসবুকে, নাকে পাইপ লাগানো, শুকিয়ে গেছেন, অচেতন, চেনাই যাচ্ছে না। তাঁকে দেখলে কষ্ট পাব, বরং তার যে দিব্যকান্তি সদাহাস্যোজ্জ্বল মুখ মনের মধ্যে আঁকা আছে, ওইটাই থাকুক।

বেলাল ভাইয়ের নিজের লেখা কবিতার মতো করে বলি—
সে কি তার মৃত্যু দৃশ্যে
পেয়েছিল পরিপূর্ণতা, কে জানে!
না হলে ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসিটি
কি করে ফুটিয়ে তুলেছিল ঐ বিভ্রম;...

বেলাল ভাই শামসুর রাহমানকে ডাকতেন ‘স্যার’ বলে। এইটাও একটা শিক্ষা, তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। আমি বহু লেখককে ‘স্যার’ বলে ডাকি, তাঁরা আমাকে বলেছেন, স্যার বলো কেন, স্যার বলেন কেন, ভাই ডাকেন। আমি বলি, বলি না! ভালো লাগে তো।

বেলাল ভাইয়ের কাছে আমাদের বহু ঋণ। এই সব ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না। উত্তমর্ণ বেলাল ভাই, শান্তিতে ঘুমান।