থ্রি বিলবোর্ডস, আউটসাইড (?)

নিজের কিশোরী কন্যার ধর্ষক ও হত্যাকারীরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় বিলবোর্ড টাঙিয়ে মিলড্রেডের প্রতিবাদ
নিজের কিশোরী কন্যার ধর্ষক ও হত্যাকারীরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় বিলবোর্ড টাঙিয়ে মিলড্রেডের প্রতিবাদ

আমেরিকার মিজৌরি রাজ্যের ছোট্ট শহর এবিং। সেখানে ঢোকার মুখে ড্রিংকওয়াটার রোড। রাস্তার পাশে অতিকায় তিনটা বিলবোর্ড।
প্রথমটিতে লেখা: রেপড হোয়াইল ডায়িং (হত্যাকালে ধর্ষিত)
দ্বিতীয়টি: স্টিল নো অ্যারেস্ট? (এখনো গ্রেপ্তার হলো না কেউ?)
তৃতীয়টি: হাউ কাম চিফ উইলোবি? (এটা কীভাবে সম্ভব চিফ উইলোবি?)

বিলবোর্ডগুলো ভাড়া নিয়েছিলেন মিলড্রেড নামের এক মধ্যবয়সী নারী। সাত মাস আগে তাঁর কিশোরী কন্যা ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এবিংয়ের পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ক্ষুব্ধ মিলড্রেড তাই বেছে নেন এক অভিনব পন্থা। তিনটা বিলবোর্ড ভাড়া করে তিনি এবিংয়ের পুলিশপ্রধান উইলোবির কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, এটা কীভাবে সম্ভব উইলোবি?

এ বছর তিনটা অস্কার এবং আরও বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজয়ী ছবি থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড এবিং, মিজৌরি শুরু হয় এভাবে। অস্কার পাওয়ার আগেই এই ছবি নিয়ে হুলুস্থুল শুরু হয়। এ রকম হুলুস্থুল ফেলা ছবি ঢাকায় বসেই দেখার ব্যবস্থা আছে ডিজিটাল যুগে। আমি থ্রি বিলবোর্ডস দেখি আর চমকে চমকে উঠি। কীভাবে বানায় মানুষ এমন শক্তিশালী এবং ধারালো ছবি?

থ্রি বিলবোর্ড-এ চমকে যাওয়া বহু কিছুর মতো আছে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংলাপ। এ রকম একটা সংলাপ তুলে দিচ্ছি। বিলবোর্ড দেখে ক্ষুব্ধ পুলিশপ্রধান উইলোবি তাঁর একজন সার্জেন্টকে নিয়ে গেছেন বিলবোর্ডটি যারা ভাড়া দিয়েছে সেই বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছে। সেখানে পুলিশ সার্জেন্টের সঙ্গে বিলবোর্ড ভাড়া প্রদানকারী রেড ওয়েবলি-এর কথোপকথন (শালীনকৃত) :

পুলিশ সার্জেন্ট: কী ঘোড়ার ডিম করছ তুমি রেড, অ্যাঁ! বিলবোর্ড দিয়ে ভরে ফেলেছ। এর কী খেসারত দিতে হবে বোঝো?
রেড: কী খেসারত আছে আইনে?
পুলিশ: তোর মতো পিচ্চি একটা পাঙ্ককে আইনের ব্যাখ্যা দিতে হবে?
রেড: আমি তো কোনো আইন ভাঙছি না! আমি দেখেছি সব!
পুলিশ: ও তাই! কই দেখেছ?
রেড: ওই একটা বইতে!
পুলিশ: কোন বই? জিনিয়াস?
রেড: সাক মাই অ্যাস! কোন বই পড়েছি তা তোমার ব্যাপার না!

একপর্যায়ে পুলিশপ্রধান তাঁর কাছ থেকে বিলবোর্ড ভাড়া নেওয়া ব্যক্তি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। রেড কোনো তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। বলেন, তাঁর ক্লায়েন্ট সম্পর্কে কোনো তথ্য তিনি দেবেন না। উইলোবির প্রশ্ন; তুমি এবিং পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে লাগতে চাচ্ছ?
রেড: মনে হয় তা-ই চাচ্ছি!
থ্রি বিলবোর্ডস এবিং-এ ভালো পুলিশ আছে, খারাপ পুলিশ অফিসার আছে। জেশন ডিক্সন নামের এই পুলিশ অফিসারই অন্যতম চরিত্র ছবিতে, এতে অভিনয় করে অস্কারও পেয়েছেন স্যাম রকওয়েল। ছবিতে একপর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে রেডকে তিনি জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলে নতুন পুলিশপ্রধান সঙ্গে সঙ্গে চাকরিচ্যুত করে তাকে। অনুতপ্ত ডিক্সন ধর্ষকের খোঁজে পরে এসে হাত মেলায় মিলড্রেড-এর সঙ্গে।

থ্রি বিলবোর্ডস দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল, আচ্ছা এ রকম একটা বিলবোর্ড কেউ দেওয়ার সাহস পাবে ঢাকা শহরে ঢোকার মুখে? যেমন: সাগর-রুনি নির্মম হত্যাকাণ্ডে আজও গ্রেপ্তার হয়নি কেউ। তিনটা বিলবোর্ড করা হলো এমন: নিজ ঘরে নৃশংস খুন! ছয় বছরে গ্রেপ্তার হলো না কেউ? ব্যাপার কী পুলিশ আইজি? এই বিলবোর্ড লেখার সাহস হলেও কেউ কি তা ভাড়া দেবে? দিলে তাঁর কী অবস্থা করবে পুলিশ?
সবই না হয় সম্ভব হলো। তারপর? আসুন কল্পনা করি, পুলিশের বড়কর্তা বিলবোর্ড ভাড়া দেওয়া অফিসে ঢুকলেন স্থানীয় ওসিকে নিয়ে।
ওসি: ওই মিয়া, এটা কেমন হলো? আপনি তো ঝামেলায় পড়বেন।
বিজ্ঞাপনী কর্মকর্তা: কিসের ঝামেলা! আমি আইন জানি না?
ওসি: ওরে পণ্ডিত! কেমনে জানলেন আইন?
বিজ্ঞাপনী কর্মকর্তা: সেটা তোমাকে বলতে হবে? ভাগো এখান থেকে! পুলিশের বড়কর্তা কড়া চোখে তাকালেন কর্মকর্তার দিকে। পুলিশের সঙ্গে লাগতে চাও নাকি?
বিজ্ঞাপনী কর্মকর্তা: তাই তো মনে হচ্ছে!
অসম্ভব না এ দেশে এসব? কিন্তু আমেরিকায় কি আসলে সম্ভব এমন? সম্ভব। থ্রি বিলবোর্ডস-এর পরিচালক নিজেই বলেছেন, টেক্সাসের এক বিশাল প্রান্তরে বিচারের দাবিতে এমন বিলবোর্ড দেখেই তিনি ছবিটি বানানোর অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। ছবি মুক্তি পাওয়ার পর বিলবোর্ড লিখে বিচার দাবি করেছে আগে এমন কিছু মানুষও পাওয়া গেছে।

আসল বিষয় সেটাও না আমার কাছে। আসল বিষয়, পুলিশের সঙ্গে সাধারণ নাগরিকের সংলাপ। কারও আমাদের সাহস আছে পুলিশের কাছে আইনের ব্যাখ্যা চাওয়ার, আইনটা কী তা মুখের ওপর বলার? আমাদের কি সাহস আছে এমনকি বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করতে এলে কারণটা জানতে চাওয়ার?
পরিচয় নিয়ে সন্দেহ থাকলে তা জানতে চাওয়ার? সাহস আছে উপযুক্ত ক্ষেত্রে পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করার? এসব নিয়ে এমনকি নাটক বা সিনেমা বানানোর?

এসব প্রশ্ন নতুন করে মনে ভিড় জমে পুলিশের এক ডিআইজি মিজানের কাণ্ডকীর্তি জানার পর। তাঁর বিরুদ্ধে জোর করে করা দ্বিতীয় বিয়ে লুকাতে ক্ষমতার অপব্যবহার ও নারী নির্যাতনের প্রমাণ পেয়েছিল খোদ পুলিশের তদন্ত কমিটি। এরপর তিনি গ্রেপ্তারও হননি, চাকরিও যায়নি। শুধু তাঁকে পুলিশ সদর দপ্তরে বদলি করা হয়েছিল মাত্র।

এটা যে তাঁকে থামানোর মতো কোনো শাস্তিই না, আসলে তার প্রমাণ তিনি অল্পদিনেই দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এখন অভিযোগ উঠেছে, এক সংবাদপাঠিকার বিরুদ্ধে প্রাণনাশের হুমকি ও উত্ত্যক্ত করার। আর সেই নারকীয় হুমকির ভাষা কী! আতঙ্কিত অভিযোগকারী ও তাঁর স্বামী একমাত্র সন্তানকে নিয়ে চার মাস ধরে গৃহবন্দী হয়ে আছেন এই ‘সভ্য’ শহরে।

মিজানুর এখনো গ্রেপ্তার হননি, পুলিশ নাকি এখনো খতিয়ে দেখছে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ। এসব শুনলে আমাদের মনের ভেতরের বিলবোর্ডে অসংখ্য প্রশ্ন কিলবিলিয়ে ওঠে না? চিত্কার করে কিছু জিনিস জানতে ইচ্ছে করে না?

অথচ মিজানুর ধরনের পুলিশ যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে এ দেশে। মাত্র কিছুদিন আগে বিএনপির শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের আক্রমণের ছবি ক্যামেরায় ধারণ করার সময় দুই সাংবাদিককে ঘাড়ে থাবা দিয়ে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়েছেন পুলিশের এক মধ্যপর্যায়ের অফিসার। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে আরেক অফিসার কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ডাকেন কথা বলার জন্য। তাঁদের উপযুক্ত সাড়া না পেয়ে তিনি একেবারে তাঁদের ‘খায়া’ ফেলার হুমকি দিয়ে গর্জে ওঠেন। আন্দোলনকারীদের ‘খায়া’ ফেলার ফাঁদ রচনার জন্য অজ্ঞাতনামা বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পরে মামলাও হয়েছে। মামলা হয়নি শুধু শিক্ষার্থীদের গুলি আর বেধড়ক পিটিয়ে আহত করার ঘটনার।

হুমকি, হামলা, মামলা তো তবু সহনীয়। পুলিশের হেফাজতে আনার পর মরে যাওয়ার ঘটনাও এ দেশে এখন ঘটে প্রায় নিয়মিত। আইন আছে, আদালত আছে, জনদরদি রাজনীতিবিদেরা আছেন, জাগ্রত সুশীল সমাজ আছে। কিন্তু পুলিশের কোনো উপযুক্ত বিচার হয় না এ দেশে। এর সবচেয়ে গূঢ় কারণ যা তা-ও আমরা হয়তো জানি। অনেকেই জানে। কিন্তু আমাদের বলার সাহস নেই।

মনে মনে তাই ভাবি থ্রি বিলবোর্ডস-এর মতো ছবি হবে এ দেশে একদিন। দশ-বিশ বছর পরে হলেও হবে। সেখানে কী কী বিলবোর্ড থাকতে পারে মনে মনে সাজাই। কোনো কোনো বিলবোর্ডের লেখা দেখে নিজেই চমকে যাই। কী থাকবে সেখানে, সেটা বলার সাহস আমারও নেই।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক