বিদ্যুতের বদলে আলু ও ইলিশ আসুক

বিপ্লব দেব
বিপ্লব দেব


ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে টানা ২৫ বছরের বাম শাসন এবং মানিক সরকারের ২০ বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বের অবসান ঘটিয়েছেন বিপ্লব দেব। ত্রিপুরায় তাঁর নেতৃত্বে সরকার গঠন করেছে বিজেপি। রাজ্য বিজেপির সভাপতি ও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছেন প্রথম আলোর।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর ত্রিপুরা প্রতিনিধি তরুণ চক্রবর্তী

প্রথম আলো: আপনার দল বিজেপি মুসলিমবিরোধী, আবার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিও চাইছেন, সেটি কীভাবে সম্ভব?
বিপ্লব দেব: যাঁরা রাজনৈতিকভাবে হেরে গিয়েছেন, যাঁদের রাজনৈতিক আদর্শকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে, তাঁরা নিজেদের রাজনীতিকে রক্ষা করতে এসব কথা বলেন। আপনি কি দেখেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী কোনো দিন এ ধরনের কোনো বিবৃতি দিয়েছেন? যাঁরা এ ধরনের কথা বলেন, তাঁরাই সাম্প্রদায়িক। দেশের মধ্যে যত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশবিরোধী কাজ হচ্ছে, তাঁরাই করছেন। নরেন্দ্র মোদির মূলমন্ত্র ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। এখানে কোনো জাতিগত ভেদাভেদ নেই। সবার জন্যই তিনি উন্নয়নের দিশা জোগাচ্ছেন। যাঁরা বিদেশি রাজনৈতিক দর্শনে চলেন (ইঙ্গিত কমিউনিস্টদের দিকে), তাঁরাই বিজেপির নামে অপপ্রচার চালান ।

প্রথম আলো: ত্রিপুরার তিন দিকই ঘেরা বাংলাদেশের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চাইছেন?
বিপ্লব দেব: আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিবেশী সব দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চান। আর বাংলাদেশ তো আমাদের পাশেরই দেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই সুসম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা সবাই জানেন। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল বলেই সেটা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমিও ভালো সম্পর্ক চাই। বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করতে চাই। আমার ধারণা, বাংলাদেশও সেটা চায়।

প্রথম আলো: একসময় বাংলাদেশে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটি ছিল। ত্রিপুরার চরমপন্থীরাও সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। এখনো কোনো নিরাপত্তাঝুঁকি আছে বলে মনে করেন?
বিপ্লব দেব: দেখুন, আমি যতটা জানি, ভারত ও বাংলাদেশ দুটি দেশই উগ্রপন্থীদের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁদের ভূমিতে সন্ত্রাসবাদী কাজ চলতে দেবেন না। অনেক আগেই তিনি সেই ঘোষণা দিয়েছেন এবং কার্যকরও করছেন। ভারতের ভূমিকাও একই। ভারতের সন্ত্রাসবাদীরা বাংলাদেশে ক্যাম্প করে তার পরিকল্পনা করবে, আমার মনে হয় না বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সেটা করতে দেবেন।

প্রথম আলো: অনেকেরই অভিযোগ, বাংলাদেশ থেকে প্রচুর মুসলমান আসামে অবৈধভাবে যাচ্ছেন। ত্রিপুরার কী অবস্থা?
বিপ্লব দেব: দেখুন, ত্রিপুরায় তেমন কোনো সমস্যা আছে বলে আমার কাছে তথ্য নেই। মাত্র আড়াই মাস হয় সরকার গঠিত হয়েছে। মাঝেমধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থী কিছু ধরা পড়ে। আমরা ফেরত পাঠাই।

প্রথম আলো: তাহলে বেআইনি অনুপ্রবেশ হচ্ছে না ত্রিপুরায়?
বিপ্লব দেব: ত্রিপুরায় সেটা কমই হয়। আগে কী হয়েছে জানি না, এখন অবৈধ অনুপ্রবেশ আমাদের রাজ্যে কোনো সমস্যা নয়। তবে অনুপ্রবেশের বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের। বিএসএফ দেখে।

প্রথম আলো: এনআরসি (জাতীয় নাগরিক নিবন্ধ) নিয়ে আসামের বাঙালিরা আতঙ্কিত। তাঁরা নাকি ত্রিপুরায় চলে আসতে চাইছেন।
বিপ্লব দেব: আসাম নিয়ে আমি কোনো কথা বলব না। সেটা আমার এখতিয়ারে নেই। তবে আসাম থেকে কেউ আমাদের রাজ্যে চলে আসছেন, এটা ঠিক নয়। ত্রিপুরায় এনআরসি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।

প্রথম আলো: কোনো বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে ত্রিপুরার?
বিপ্লব দেব: অনুপ্রবেশ নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তবে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে কিছু দ্বিপক্ষীয় সমস্যা থাকেই। আলোচনার মাধ্যমেই সেটা মিটিয়ে নিতে হয়।

প্রথম আলো: প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ বৈধ পথে ত্রিপুরায় আসেন, কেউ বেড়াতে, কেউ চিকিৎসার জন্য। কেউবা ত্রিপুরা হয়ে আকাশ পথে অন্য কোথাও যান।
বিপ্লব দেব: বৈধ পথে কেউ এলে অবশ্যই স্বাগত। ভারতবর্ষের চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত। তারপরও আমরাও অন্য দেশে যাই। তাই বাংলাদেশিরা যদি চিকিৎসার জন্য আসেন, স্বাগত। অর্থনীতিও লাভবান হবে।

প্রথম আলো: পর্যটনের উন্নয়নে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে কিছু করার পরিকল্পনা আছে কি?
বিপ্লব দেব: ভবিষ্যতে চিন্তা করা যেতে পারে। আসল ব্যাপার হচ্ছে, ২৫ বছর যাবৎ একটা সরকার ছিল, তাদের পর্যটন, শিল্প বা স্বাস্থ্যের উন্নয়নের মানসিকতাই ছিল না। আমাদের সরকার পর্যটনের উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছে। আমরা ইউরোপের মতো বন্দোবস্ত করতে চাই।

প্রথম আলো: আগরতলা-ঢাকা-কলকাতা বাস সার্ভিস নিয়ে কিছু বলবেন?
বিপ্লব দেব: ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে আমি লিখেছি, বাসে যাওয়ার সময় ছয়-সাত ঘণ্টা তল্লাশিতেই লেগে যায়। এটা কমানো দরকার। দুই মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সময়টা কমাতে হবে। না হলে যাত্রী হবে না। পর্যটনের উন্নয়ন করতে হলে ঝামেলা কমাতে হবে।

প্রথম আলো: ভিসা পদ্ধতিকে আরও সহজ করা উচিত নয় কি?
বিপ্লব দেব: দেখুন, ভিসা পদ্ধতি কেন্দ্রের বিষয়। আমার বলাটা ঠিক হবে না। যেটা বলব, উভয় দেশ মিলে বসে ঠিক করুক। তবে ওপরতলার সিদ্ধান্ত যাতে নিচতলায়ও কার্যকর হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তল্লাশিও তো একসঙ্গে করা যায়। একজন যাত্রীকে তল্লাশির জন্য দেড়-দুই মিনিটের বেশি সময় লাগা উচিত নয়। আপনি গাড়িসুুদ্ধও চেক করতে পারেন। ইন্টেলিজেন্সকেও তো কাজে লাগানো যেতে পারে।

প্রথম আলো: ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ যাচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় ব্যবসাকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে চান?
বিপ্লব দেব: বিদ্যুৎ দেওয়ার পাশাপাশি আমরা বাংলাদেশ থেকে আলু আনতে চাই। দেখুন, বাংলাদেশে প্রচুর আলু হয়। চাঁদপুর জেলায়ও আলুর উৎপাদন প্রচুর। কিন্তু সেটা ত্রিপুরায় আনার অনুমতি নেই। আবার ত্রিপুরা থেকে রাবার, আনারস, কাঁঠাল, আগরসহ অনেক কিছু বাংলাদেশে যেতে পারে। কিন্তু সেগুলোর অনুমোদন নেই। এই বিধিনিষেধ ওঠানোর জন্য আমি ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ করেছি। আশা করি বেশি দিন লাগবে না। উঠে যাবে। আমাদেরও লাভ হবে, বাংলাদেশেরও লাভ হবে। ১ হাজার কোটি টাকার (রুপির) কাছাকাছি লাভ হবে। বাংলাদেশে যেটা সস্তা, সেটা আমরা নিয়ে আসব। চালও হতে পারে।

প্রথম আলো: ইলিশ চাইবেন না?
বিপ্লব দেব: কেন চাইব না! আমি যদি না-ও চাই, নানাভাবে বাজারে চলে আসে। কিন্তু এটা বৈধ পথে এলে ভারত সরকারও কিছু শুল্ক পাবে, বাংলাদেশও লাভবান হবে।

প্রথম আলো: আলুর ওপর ভারতের বিধিনিষেধ আছে। ভারতই চাইছে না আলু আমদানি করতে।
বিপ্লব দেব: দেখুন, বিধিনিষেধ থাকলে সেটা এই রকমভাবে করা উচিত—ত্রিপুরা দিয়ে যদি আলু আসে, সেটা বিহারে যেতে যেতে তো এমনিতে দাম বেড়ে যাবে। ত্রিপুরার মধ্যেই রাখা যেতে পারে বাংলাদেশের আলু।

প্রথম আলো: আলুর গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন আছে।
বিপ্লব দেব: সেটা আমি এখনো পরখ করে দেখিনি। কিন্তু আলুর দাম বাংলাদেশে অনেক কম। ত্রিপুরায় এলে ত্রিপুরার মানুষ উপকৃত হবে। ত্রিপুরায় কোনো খারাপ প্রভাব পড়বে না। কেন্দ্রীয় সরকার পুরো বিষয়টি বিবেচনা করবে আশা করি।

প্রথম আলো: ফেনীর ওপর মৈত্রী সেতু আর আগরতলা-আখাউড়া রেলসংযোগ নির্মাণকাজ চলছে। যোগাযোগের উন্নয়ন কতটা হবে?
বিপ্লব দেব: তিন–তিনবার আমি দিল্লিতে আমার প্রতিনিধিদল নিয়ে গিয়েছি। কাজগুলো কত দ্রুত করা যায়, সে জন্য আমি কেন্দ্রকে বলেছি। চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবহার নিয়ে ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছে। ৪ মে দিল্লিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মুখ্যমন্ত্রীদের দিল্লিতে বৈঠক আছে। সেখানেও আমি বিষয়টি ওঠাব। লিখিতভাবে চট্টগ্রাম বন্দর, ফেনীর ব্রিজ বা আখাউড়া রেলপথ বন্দর প্রভৃতি ইস্যুতে দ্রুতগতিতে কাজ করার অনুরোধ জানিয়েছি। ভারত একা গতি আনলে তো হবে না, বাংলাদেশ সরকারকেও করতে হবে। দুটিই যাতে হয়, সে জন্য বলেছি। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলাকেও বলেছি।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে?
বিপ্লব দেব: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শপথ নেওয়ার দিন বলেছিলেন প্রথমেই বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য। ইচ্ছে করলেই তো যাওয়া যায় না। অনেক প্রটোকল আছে। তার জন্য ভারত সরকারের মাধ্যমে দুই দেশের লাভ হয়, এমন কোনো পরিকল্পনা করে গেলেই লাভজনক হবে।

প্রথম আলো: আপনার পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের কোথায়?
বিপ্লব দেব: চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার মগদাই গ্রামে।

প্রথম আলো: ওখানকার কোনো স্মৃতি?
বিপ্লব দেব: আমার জন্ম তো ত্রিপুরাতেই, ১৯৭১-এর ৫ নভেম্বর। আমার আত্মীয়স্বজন রয়েছেন ওখানে।

প্রথম আলো: আপনি গিয়েছেন ওখানে?
বিপ্লব দেব: অনেকবার গিয়েছি। আমাদের ওখানে বংশপরম্পরায় পূজা হয়। আমাদের মনসাপূজা ওখানে বিখ্যাত। তার মধ্যে বরাক বাঁশ আছে। সেগুলো দূর থেকে তো দেখলে সমান মাপের। মনে হবে যেন কেউ কেটে রেখেছে। সেটা আকর্ষণ করে। সেখানেই মনসাপূজা হয়। খুব বিখ্যাত। ওই জেলার মোটামুটি সবাই জানে।

প্রথম আলো: মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ওই গ্রাম থেকে আপনার আত্মীয়রা দাওয়াত দেননি?
বিপ্লব দেব: আমন্ত্রণ তো অনেকেই জানিয়েছেন। আনন্দও করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তো কারও আত্মীয়স্বজন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে সাংবিধানিক দায়িত্ব পেলে সবারই ভালো লাগে।
প্রথম আলো: ধন্যবাদ।
বিপ্লব দেব: ধন্যবাদ।