করপোরেট করহার কমানো যায়, তবে...

দেশে করপোরেট করহার ১০ শতাংশ থেকে শুরু করে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত। করপোরেশনগুলোকে আটটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে করহার নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এটা অনেক বেশি। এবার এনবিআরের সঙ্গে প্রাক্‌-বাজেট আলোচনায় বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন করপোরেট কর কমানোর দাবি করেছে। তবে এ দাবি নতুন নয়, অনেক দিন ধরেই তঁারা এ দাবি করে আসছেন।

ব্যবসায়ী নেতাদের ভাষ্য, দেশের করজাল অতটা বিস্তৃত নয়। বহু করযোগ্য মানুষ ও প্রতিষ্ঠান রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, ফলে যাঁরা নিয়মিত কর দেন, তাঁদের বোঝাটা বেশি ভারী হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা এও বলছেন, করপোরেট করহার বেশি হওয়ায় ফাঁকির প্রবণতা বাড়ছে। কিন্তু করহার কমালেই যে ফাঁকিবাজেরা ফাঁকি দেওয়া বন্ধ করে দেবেন, তার নিশ্চয়তা কে দেবে। অন্যদিকে যাঁরা কর দেন না, তাঁদের করের আওতায় আনার বিকল্প নেই। ব্যবসায়ীদের দাবি, করহার কমালে বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু এত দিন আমরা শুনে এসেছি, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রভৃতি কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না। সহজে ব্যবসা করার পরিবেশের সূচকে আমাদের অবস্থান তলানির দিকে। বিনিয়োগযোগ্য টাকার অভাবে বিনিয়োগ হচ্ছে না, সে কথা কেউ কখনো বলেননি। দেশে রাজনৈতিক কারণে ব্যবসা করার খরচ অনেক বেশি, তাও আমরা জানি। তাই করপোরেট করহার কমালেই যে বিনিয়োগে গতি আসবে, এ কথা হলফ করে বলা যাবে না।

ব্যবসায়ীরা আরও বলছেন, অতিরিক্ত করের কারণে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারছে না। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হতে পারছেন না। অন্যদিকে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয়, তার ৭০ শতাংশই আসে কোম্পানিগুলোর রিটেইন্ড আর্নিং থেকে। কিন্তু করপোরেট করহার বেশি বলে কোম্পানির রিটেইন্ড আর্নিংয়ে প্রভাব পড়ে এবং বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়।

ঢাকা চেম্বারসের গবেষণা বিভাগের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, করপোরেট করের গড় হার ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব সংগ্রহ কমবে ৮ হাজার ৩৩ কোটি টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কমবে ১৪ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। আর গড় হার যদি ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়, তাহলে এই ঘাটতি হবে যথাক্রমে ১৪ হাজার ৮৭৫ ও ১৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। এই ঘাটতি পূরণের পথও দেখিয়েছে তারা। ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে দেশে ১ লাখ ২২ হাজার ৭৩৯ কোম্পানি নিবন্ধিত থাকলেও কর দিচ্ছে ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ কোম্পানি, বাকি ৫১ দশমিক ৪৬ শতাংশ কোম্পানি করই দিচ্ছে না। করপোরেট করহার কমিয়ে এই ফাঁকিবাজ কোম্পানিগুলোকে করের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছে তারা।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে করপোরেট করহার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২১ শতাংশ নির্ধারণ করেছেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে গতি এসেছে এবং কর্মসংস্থানও বেড়েছে। তবে জোসেফ স্টিগলিৎসসহ বড় বড় অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা করছেন, এতে দেশটিতে দীর্ঘ মেয়াদে রাজস্ব ঘাটতি হবে। তিনি বলেছেন, অতীতে করহার কমিয়ে কখনোই রাজস্ব আদায় বাড়ানো যায়নি। এতে বরং রাজস্ব ঘাটতি বেড়েছে।

সরকার পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ একসঙ্গে একাধিক বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও ব্যাপক হারে বাড়ানো হয়েছে। ফলে বাজেটের আকারও ক্রমেই বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে করপোরেট করহার কমানো হলে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাবে।
এ বছরও এনবিআর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনবে। অন্যদিকে সরকারের ঋণ ক্রমেই বাড়ছে। সে জন্য তাকে সুদও বেশি দিতে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে বাজেট ঘাটতি বাড়বে, যদি না সরকার করজাল বিস্তৃত করে ফাঁকিবাজদের করের আওতায় আনে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি মনে করে, এখনই করহার খুব বেশি কমানো ঠিক হবে না। সম্প্রতি আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারা বলে, প্রাথমিকভাবে অল্প কিছু কমিয়ে দেখা উচিত, পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়। এ নিয়ে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা উচিত। অনেকেই বলেন, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও বাইরের কোম্পানির মধ্যে করহারের ব্যবধান কমানো উচিত। যদিও সিপিডি বলেছে, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি ৫০ হাজার কোটি টাকা হয়ে যাবে।

কথা হলো করপোরেট করহার আমাদের দেশে বেশি এটা যেমন সত্য, তেমনি এ দেশের মানুষ কর দিতে চায় না, সেটাও সত্য। কর ফাঁকির প্রবণতা আমাদের মজ্জায়। আবার সরকারও ঠিকঠাক সেবা দেয় না। বিশ্বব্যাংক ও প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারসের পেয়িং ট্যাক্স ২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা যায়, সার্বিকভাবে করবান্ধব বা কর প্রদান সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৫১তম। রাজস্ব কর্মকর্তাদের আচরণ করদাতাবান্ধব নয়—এমন অভিযোগও ভূরি ভূরি পাওয়া যাবে। এ পরিস্থিতিতে শুধু করপোরেট করহার কমালে সরকারের বিপদে পড়ার আশঙ্কাই বেশি। এতে ক্রমবর্ধমান রাজস্ব ঘাটতি আরও বাড়বে।

সমস্যা সমাধানে ব্যবসায়ীরা সব সময়ই করহার কমানো বা নিয়মকানুন শিথিল করার পরামর্শ দেন। তাঁরা নানা সমস্যার কথা বলেন, সুযোগ-সুবিধা দাবি করেন। সারা পৃথিবীতেই এই প্রবণতা কমবেশি দেখা যায়। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে আসছে। সামনের দিনে তাঁকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। তাই ব্যবসায়ীদের এখন থেকেই প্রতিযোগিতার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। দক্ষতা বাড়াতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করার মানসিকতা দরকার। তাঁদের এখন সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার মানসিকতা পরিবর্তনের সময় এসেছে।

যাহোক, ব্যবসায়ীদের দাবির সঙ্গে অর্থমন্ত্রীও নানা সময় একমত পোষণ করেছেন। সবাই চাইলে এই হার কমানো যেতেই পারে। কিন্তু তার সঙ্গে আরও কিছু কাজ করতে হবে। করজাল যেমন বড় করতে হবে, তেমনি কর দেওয়ার ব্যবস্থাও সহজতর করতে হবে। প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো করজালের আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি, মানুষের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। যঁার আয় যত বেশি, তাঁকে তত বেশি কর দিতে হবে। আবার যাঁরা কর দেন, তাঁদের বোঝা বাড়ানো যাবে না। সরকারের খরচ যখন বাড়ছে, তখন তার রাজস্ব আয় কমতে পারে না। সেটা নিশ্চিত করেই করপোরেট করহার কমানোর চিন্তা করা উচিত।

প্রতীক বর্ধন ্রথম আলোর সহসম্পাদক