উন্নয়ন গণতন্ত্রের বিকল্প নয়

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যেহেতু বাংলাদেশে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, তাই নির্বাচনের সময় যতই এগিয়ে আসতে থাকবে, ততই যে প্রশ্নগুলো দেশের রাজনীতিকে উত্তপ্ত করতে থাকবে তা হলো—এবারের নির্বাচন অবাধ, জালিয়াতিমুক্ত ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক হবে? নাকি ২০১৪ সালের মতো চাণক্য বুদ্ধির আরেকটা খেলার শিকার হয়ে ক্ষমতাসীন জোটের যেনতেনভাবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার প্রহসনে পরিণত হবে? ১৯৯১ সালে নির্বাচনী গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার কোনোটিতেই ক্ষমতাসীন দল বা জোট পুনর্নির্বাচিত হয়নি, কারণ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের কারণে প্রতিবারই ক্ষমতাসীন সরকার দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছিল।
২০১৪ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মহাজোট একতরফা নির্বাচনে দ্বিতীয়বার জেতার সৌভাগ্য অর্জন করেছিল। এবার বিএনপি আর এ ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে হয় না। অতএব, অবাধ ও জালিয়াতিমুক্ত নির্বাচন হলে সামনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিততে পারবে কি না, তা এক বড় প্রশ্ন। কারণ, মহাজোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের বর্তমান নয় বছরের মেয়াদে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের কারণে জনগণের পক্ষে সরকারের ভূমিকাকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা কঠিন। নিত্যদিনের দুর্নীতি ও অপশাসনের শিকার জনগণের মনে এসব স্মৃতি এখন অনেক বেশি তরতাজা, ২০০১-২০০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোটের দুর্নীতির কাহিনিগুলো এত দিনে অনেকটুকু ফিকে হয়ে গেছে। অথচ গত নয় বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জনগুলো দেশটির অতীতের নেতিবাচক ইমেজকে ক্রমেই পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। কিন্তু এর সুফল আওয়ামী লীগ নির্বাচনী বিজয়ের মাধ্যমে নিজেদের ঘরে তুলতে পারবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।

অন্যদিকে, উন্নয়নের সাফল্যগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার তাগিদে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে ছাড় দেওয়া যায় বলে কিছু পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তির কিছু লেখালেখি আমার নজরে এসেছে। যেখানে মাহাথির মোহাম্মদের আমলের মালয়েশিয়ার নজির টেনে বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তাঁর দীর্ঘ শাসনামলে গণতন্ত্রের কিছু ঘাটতি পরিলক্ষিত হলেও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকায় মালয়েশিয়া এখন উন্নত দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হওয়ার অবস্থানে পৌঁছে গেছে। আমি মনে করি, মাহাথিরের আমলে মালয়েশিয়ার নির্বাচন জালিয়াতিপূর্ণ ছিল না। তাঁর এককালের রাজনৈতিক সহযোগী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে মাহাথিরের অতীতের রাজনৈতিক আচরণকে অনেকে আপত্তিকর মনে করতেও পারে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনোয়ারের বিশেষ দহরম-মহরমই যে ব্যাপারটায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল, সেটা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। মাহাথির সাহসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কথিত ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’কে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই মালয়েশিয়ার অর্থনীতি ‘ইকোনমিক মেল্টডাউন’ এড়াতে পেরেছিল।

অতএব, বাংলাদেশে উন্নয়নের স্বার্থে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বর্তমান সরকারকে যেনতেনভাবে জিতিয়ে আনার থিসিস যাঁরা উপস্থাপন করছেন, তাঁরা প্রকারান্তরে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শত্রুতা করছেন। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের জিএনআই (মাথাপিছু জাতীয় আয়) প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে বর্তমানে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অতিক্রম করেছে, কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির সুফল অনেকটুকুই রাজনৈতিক দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন এবং আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির ফায়দাভোগীদের দখলে চলে যাচ্ছে। আমার মতে, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে শেখ হাসিনার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার চাবিকাঠি হচ্ছে এই দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে তিনি যে সত্যিই আপসহীন, সেটা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা।

নির্বাচনের আগে আট মাস সময় রয়েছে। তিনি চাইলে এই আট মাসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবেন। এমনকি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী মনোনয়নে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমেও তিনি জনগণকে এই বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন যে দুর্নীতির ব্যাপারে তিনি সত্যি সত্যিই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েছেন। তাহলে তাঁর আমলে অর্জিত অর্থনৈতিক সাফল্যকে জনগণ যথাযথভাবে মূল্যায়ন করবে বলেই আমার বিশ্বাস। ২০১৮ সালে
আরেকটি জালিয়াতিপূর্ণ সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ দেশকে মহাসংকটের গিরিখাদে নিক্ষেপ করবে বলেই আমার আশঙ্কা।

সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র এখনো প্রান্তীয় পুঁজিবাদী, আমলাতান্ত্রিক এবং পুঁজি লুণ্ঠনমূলক রয়ে গেছে। অনুন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে চলেছে বাংলাদেশের এই রাষ্ট্রচরিত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে এই রাষ্ট্রকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রে’ রূপান্তরিত করা। সে জন্যই এই রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি নির্দিষ্ট করা হয়েছিল—বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। ১৯৭৫ সালের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পথ ধরে রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলকারী সমরপ্রভুদের অবৈধ ও অসাংবিধানিক কাটাছেঁড়ার পর্ব পেরিয়ে ২০১১ সালে রাষ্ট্রের এই চারটি মূলনীতি আবারও সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন জাতির প্রধান আরাধ্য ও দায়িত্ব হলো অনুন্নয়নের সংকটের ভূমিকা থেকে এ দেশের রাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়ে এসে সত্যিকার অর্থে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা। গণতন্ত্রকে দৃঢ়মূল করতে না পারলে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ কীভাবে অর্জিত হবে? গণতন্ত্রই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে, উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে জালিয়াতির শিকারে পরিণত করা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।

মনে রাখতে হবে, ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে পাকিস্তানি আদলের উন্নয়ন কৌশল আবারও জেঁকে বসেছিল। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুঁজিবাদ গড়ে তোলার যে পাকিস্তানি মডেলটা চালু হয়েছিল, তাতে যে ধরনের পুঁজির বিকাশ এ দেশে ঘটেছে, তার চরিত্র প্রধানত মুৎসুদ্দি পুঁজির। সে জন্যই, শিল্প স্থাপনের জন্য উদার ব্যাংকঋণ প্রদান করা হলেও পাচার হয়ে যাচ্ছে বাণিজ্যে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চোরাচালানে।

বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশ বিংশ শতাব্দীর শেষ ২৫ বছর ‘নব্য উপনিবেশ’ হিসেবে শুধু অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বই যে হারিয়েছিল তা-ই নয়, বরং এর রাজনৈতিক স্বাধীনতাও ওই সময়ে নামকাওয়াস্তে হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান এ দেশের জিডিপির ১৩ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। ২০১৭ সালে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদাননির্ভরতা ক্রমেই কমে জিডিপির ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। আবার এ দেশে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল কারণ নিহিত রয়েছে রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক চরিত্রের মধ্যে। উপরন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা যেসব দেশে শাসকদের এবং তাদের আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের পুঁজি লুণ্ঠনের লোভনীয় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেই সব দেশে অনুন্নয়ন গেড়ে বসে থাকে। উন্নয়নতত্ত্বে এর নাম ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ বা স্বজনতোষী পুঁজিবাদ। গত ৪৭ বছর ক্ষমতায় থাকা দেশের কোনো সরকার স্বজনতোষণের বদ খাসলতমুক্ত ছিল না।

আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য যে এ দেশে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে, তা ঠিকমতো স্বীকারও করা হচ্ছে না। অথচ ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি’ কৌশল অবলম্বন করে এখনো সমতাকামী সমাজ প্রতিষ্ঠা খুবই সম্ভব। কৃষিতে গণমুখী নীতি প্রণয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য হ্রাস, দরিদ্র জনগণকে সুলভে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, সুলভে জনগণের কাছে ব্যাংকঋণ পৌঁছানো এবং সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তাব্যবস্থাকে জোরদার করা এই কৌশলের মূল স্তম্ভ। সর্বোপরি আয় পুনর্বণ্টনকে রাষ্ট্রের মূল মিশন হিসেবে গ্রহণ করতেই হবে। ১৯৯১-২০১৮ পর্বে বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার পদ্ধতি চালু রয়েছে মনে হলেও ২০১৪ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি থমকে গেছে। যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক, নির্বাচনী গণতন্ত্রকে প্রতিনিধিত্বশীল এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক করে তোলা এখন জাতির প্রধান চ্যালেঞ্জ। কারণ, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র পরিপূরক। উন্নয়নকে গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে তুলে ধরার অপপ্রয়াস অচিরেই পরিত্যাজ্য।

ড. মইনুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইউজিসি অধ্যাপক