একজন ভালো মানুষ চলে গেলেন

বেলাল চৌধুরী
বেলাল চৌধুরী

বেলাল চৌধুরী-আমাদের সবার বেলাল ভাই দেশের প্রধান কবিদের একজন ছিলেন না। খুব লড়াকু একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবেও তাঁর তেমন কোনো খ্যাতি ছিল না। কখনো কোনো সভায় বা আড্ডায় তাঁকে উচ্চকণ্ঠ হতে দেখা গেছে, এমন কথাও কেউ বলবে বলে মনে হয় না। অথচ এই মানুষটির মৃত্যুতেই দেশের প্রধান কবি, প্রধান বুদ্ধিজীবী, এমনকি প্রধান রাজনীতিবিদেরাও প্রকাশ্যে তাঁদের ব্যক্তিগত ক্ষতির কথা বলেছেন। ক্ষতিটা শুধু তাঁদের ব্যক্তিগত নয়, দেশেরও, এমন কথা অনেকে বলেছেন।

আমাদের এই আক্ষেপ, এই ক্ষত-হৃদয় বেদনার উচ্চারণ, তার সম্ভবত একটাই কারণ। সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একজন মানুষ ছিলেন তিনি। যাঁরা তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন, সবাই এক বাক্যে বলবেন, নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্য বেঁচে ছিলেন বেলাল ভাই। খুব যে ক্ষমতাবান মানুষ ছিলেন, সে কথা বলা যাবে না; অথচ নিজের ক্ষমতার আয়ত্তে আছে এমন কিছু অন্যের জন্য করতে কখনো বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি তিনি। কত লোক কতভাবে তাঁর কাছ থেকে উপকৃত হয়েছেন, তার লেখাজোখা নেই। যখন নিজের সাধ্যে কুলোয়নি, নিকট বন্ধুদের দিকে তাকিয়েছেন সাহায্যের আশায়। না, নিজের জন্য নয়, চেনা অথবা স্বল্প চেনা যে কারও জন্য।

আমি নিজে তাঁর কাছ থেকে বহুবার বহুভাবে উপকৃত হয়েছি। আমার কর্মজীবনের প্রথম সুযোগটি তাঁর হাত ধরেই এসেছিল। ১৯৮০ সালের কথা, তখন আমি সদ্য বিদেশ থেকে ফিরে এসেছি, সাংবাদিক নই, লেখকও নই। অগ্রজপ্রতিম মফিদুল হক আমাকে বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর অফিসে এসে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, দেখুন, একে দিয়ে কিছু হয় কি না। তখন তিনি সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে। দেশের সবচেয়ে চৌকস, সবচেয়ে সুন্দর সাপ্তাহিক হিসেবে সেটি সর্বত্র আদৃত। মাত্র কয়েক মুহূর্তের কথাবার্তা, সেই থেকে তাঁর সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্রপাত হয়, শুধু মৃত্যুতেই তাতে ছেদ পড়ল।
বেলাল ভাই সম্পাদক ছিলেন, অথচ কখনো সম্পাদকসুলভ মনোযোগ দাবি করতেন না। সে সময় হাতে গোনা জনা কয়েক কম বয়সী ছেলেমেয়ে সেই পত্রিকার নিয়মিত লেখক। বিখ্যাত লেখকেরা অবশ্যই লিখতেন, বেলাল ভাই নিজের ব্যক্তিগত প্রভাব ব্যবহার করে তাঁদের কাছ থেকে লেখা আদায় করে নিতেন, তবে তাঁদের অধিকাংশের সঙ্গে আমাদের কালেভদ্রে দেখা হতো। বেলাল ভাই-ই ছিলেন আমাদের সারথি, আমাদের শিক্ষক ও বন্ধু। কত ভুল, বিভ্রান্তিকর কথা লিখেছি, একদিনও গলা উঁচু করেননি। কখনো আমাকে জানিয়ে, কখনো আমার অজ্ঞাতে সেই ভুল শুধরে দিয়েছেন। মনে পড়ছে, সাবেক বিটলস গায়ক জন লেনন নিউইয়র্কে নিহত হওয়ার পর আমার ওপর ভার দিয়েছিলেন একটি দীর্ঘ ফিচার লিখতে। কী লিখতে হবে, কোন কোন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে, ব্যাখ্যা করে বলে দিয়েছিলেন। লেখাটি ছাপা হলে দেখি তাতে লেননের বিখ্যাত গান, ইমাজিন, এর বাংলা অনুবাদ। রচনাটি আমার নামে, অনুবাদটিও, যদিও সেই অনুবাদ আমি করিনি। কত লোক সেই অনুবাদ নিয়ে প্রশংসা করেছেন, বেলাল ভাই একবারও মুখ ফুটে বলেননি অনুবাদটি আমার নয়-তাঁর।
সম্পাদক হিসেবে বেলাল ভাই নিজের ‘আইডিয়া’ তাঁর লেখকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার বদলে তাঁদের কাছ থেকে শুনতে চাইতেন কোন বিষয়টি নিয়ে লিখতে তাঁরা বেশি আগ্রহী। মনে পড়ছে, সে সময় দেবব্রত বিশ্বাসকে কলকাতায় বিশাল নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও দেবব্রত একসঙ্গে গান গেয়ে শুনিয়েছেন। সেই প্রতিবেদন পড়ে দেবব্রতকে নিয়ে আমি লিখতে আগ্রহ প্রকাশ করায় বেলাল ভাই অবহেলিত এই শিল্পীর স্মৃতিকথা ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত গ্রন্থখানি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আমার সেই লেখা, যত দূর মনে পড়ে, পত্রিকার প্রচ্ছদকাহিনি হয়েছিল। আমি লেখার শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘এই মণিহার আমায় নাহি সাজে’। বেলাল ভাই সেটা সামান্য বদলে নাম দিলেন, ‘এই মণিহার তাঁরই সাজে’। শুধু একটি শব্দের ব্যবধান, অথচ দুই শিরোনামে কী বিস্তর প্রভেদ!

সচিত্র সন্ধানী ছেড়ে বেলাল ভাই ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের পত্রিকা ভারত বিচিত্রা সম্পাদনার ভার নিলেন। কথা অনেক দিন থেকেই চলছিল, পত্রিকা কেমন হবে তা নিয়ে আমাদের সঙ্গেও এক-আধবার মতবিনিময় করেছিলেন। সে সময় আমাকে বলেছিলেন, তোমার জন্য একটা ‘সারপ্রাইজ’ থাকবে প্রথম সংখ্যায়। খুলে বলেননি কী সেই সারপ্রাইজ। পত্রিকা প্রকাশের পর দেখি তাতে আমার একটি লেখা রয়েছে, পরিতোষ সেনের স্মৃতিকথা, জিন্দাবাহার নিয়ে স্তুতিমূলক একটি আলোচনা। কবে সেই রচনা লিখেছি, বেলাল ভাই কীভাবে তা সংগ্রহ করেছিলেন, আমার মনে ছিল না। পরে জেনেছিলাম, সন্ধানীতে কাজ করার সময় লেখাটি তাঁরই নির্দেশে প্রস্তুত করেছিলাম। হয়তো ভালো লেগেছিল, অন্য কোথাও ছাপবেন ভেবে আলাদা করে রেখে দিয়েছিলেন। আমি ক্ষুদ্র লেখক, জীবনে কখনো এমন সম্মানিত বোধ করিনি।

বেলাল ভাই আজীবন আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে গেছেন, অথচ মুখ ফুটে সে কথা কখনো বলেননি। অন্ততপক্ষে আমার চেনাশোনা কারও কাছে নয়। অথচ কত লোকই না তাঁর কাছে অর্থের অনুরোধে হাজিরা দিয়েছে। নিজের পকেটে উদ্বৃত্ত অর্থ নেই, পরিচিত কারও কাছে সেই সব লোককে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমার নিজের কাছে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন, বেলাল ভাইয়ের খুব কাছের কোনো লোক এমন নন তিনি। প্রকৃত অনটনে পড়ে গিয়েছিলেন, সে কথা জানার পর খাতার কাগজ ছিঁড়ে আমার কাছে একটি অঙ্ক উল্লেখ করে লিখে পাঠিয়েছিলেন, টাকাটা দিয়ে দিও। আমাকে অনুরোধ করেছেন-এই কথা জেনে পুলকিত হয়েছিলাম।

খুব বেশি কথা বলতেন না বেলাল ভাই, যেকোনো আড্ডায় সবচেয়ে নিচু যে কণ্ঠ, সেটি থাকত বেলাল ভাইয়ের। লক্ষ করেছি, অপ্রকাশিত একটি বেদনায় ঢাকা থাকতেন তিনি, একধরনের বৈরাগ্য তাঁকে ঘিরে থাকত। কী সেই বেদনা, তা কখনোই জানা হয়নি। অথচ জীবনের সব ব্যাপারে একধরনের গভীর আশাবাদও কখনো তিনি পরিত্যাগ করেননি।

একদিনের কথা মনে পড়ছে। বেশ রাত হয়েছিল, বেলাল ভাই ও আমাদের আরেক জ্যেষ্ঠ বন্ধু কালাম মাহমুদ কী নিয়ে যেন কথা বলছিলেন। কালাম ভাই তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বেশ জোরে জোরেই কথা বলছিলেন, বেলাল ভাইকে তিনি কোনো কারণে খোঁচাচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ তাঁর কথা শোনার পর বেলাল ভাই প্রায় স্বগত কণ্ঠে বললেন, কালাম, এই রাত কেটে যখন সকাল হবে, মনে রাখবেন, সব ক্লেদ মুছে যাবে, সব অন্ধকার দূর হবে, আলো ফুটবে। তাঁর সেই কথা এখনো আমার কানে বাজে।

হাসান ফেরদৌস : যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি