মমতা যে কারণে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিততে মরিয়া

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।


ভেবেছিলাম প্রণম্য শঙ্খ ঘোষের কবিতা ও সেই কবিতা পড়ে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠা বীরভূমের দামাল ছেলে অনুব্রতর কাহিনি দিয়ে এই পঞ্চায়েত মাহাত্ম্য শুরু করব। কিন্তু সবকিছু গুবলেট করে দিলেন দিদিমণির আরেক দামাল ভাই ভাঙড়-রত্ন আরাবুল ইসলাম। পঞ্চায়েত ভোটে তাঁর কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করা এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর হয়ে প্রচারে নামা এক যুবককে ভোটের দুদিন আগে কপালে গুলি করে মেরে ফেলে আরাবুল একটা বাগানে লুকিয়ে পড়েছিলেন। মমতার নির্দেশে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। বিরোধীরা যদিও বলছে, মুখ্যমন্ত্রী আরাবুলকে তুলে নিয়ে বাঁচিয়ে দিলেন।

নতুন খবরের ধর্মই হলো পুরোনো খবরকে হটিয়ে জায়গা দখল করা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে এবার যা সব ঘটে যাচ্ছে, তাতে পুরোনো-নতুন সব মিলেমিশে একাকার। চরাচরজুড়ে জেগে রয়েছে শুধুই দিদির দল ও তাঁর দামাল ছেলেরা।

আরাবুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
আরাবুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে বিহার, উত্তর প্রদেশ কিংবা হরিয়ানার ভোটে যে ধরনের গোলমাল হতো, বছর কয়েক ধরে পশ্চিমবঙ্গে তেমনই ঘটে চলেছে। বহু বছর আগে দলহীন পঞ্চায়েতের কথা বলেছিলেন কংগ্রেসের অজাতশত্রু মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন। সেই সময়কার বামপন্থী শাসকেরা তা মানতে চাননি। তাঁদের তত্ত্ব ছিল, রাজনীতিহীনতা বলে কিছু হয় না। রাজনীতি ছাড়া গাছের পাতাও নাকি নড়ে না। সেই তত্ত্ব ক্রমেই পঞ্চায়েতকে দলসর্বস্ব করে তুলেছে। মাও সে তুংয়ের ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো’ নীতির সার্থক রূপায়ণ পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা করে গেছেন পঞ্চায়েত দখলের মাধ্যমে। ‘গ্রাম যার, রাজ্য তার’ নীতি সেই থেকে স্নেহের মতোই নিম্নগামী। বাম জমানাকে বঙ্গোপসাগরে বিসর্জন দিয়ে তৃণমূলেশ্বরী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পঞ্চায়েত দখলের মধ্য দিয়ে রাজ্যে ছড়ি ঘোরানোর ছাড়পত্র আদায় করে নিচ্ছেন। পঞ্চায়েতকে বিরোধীশূন্য রাখতে কারও সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপসে তিনি রাজি নন। রমজান শুরু হওয়ার আগে পঞ্চায়েত ভোট সেরে ফেলার যে পণ তিনি করেছিলেন, অনেক বাধা টপকে তা তিনি সাকার করতে চলেছেন। সোমবার যে ভোট, তার অনেক আগেই ৪০ শতাংশ আসন তৃণমূল কংগ্রেসের মুঠোয় চলে এসেছে। লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ না থাকলে যা হয়। বাকিটা তোলা থাকছে ভোটের দিনের জন্য।

পঞ্চায়েত দখলের জন্য কেন এমন জীবন-মরণ লড়াই, তা বলার আগে বরং শঙ্খ ঘোষের কাহিনিটা সংক্ষেপে বলে নেওয়া যাক।

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময় শঙ্খ ঘোষ অবিচল থাকতে পারেননি। কারণ, বিবেক বলে একটি বিষয় তাঁকে দংশায়। এবারের পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে বীরভূম জেলায় তৃণমূল কংগ্রেসের মুকুটহীন রাজা মমতার স্নেহধন্য অনুব্রত মণ্ডল, রাজ্যবাসী যাঁকে ‘কেষ্ট’ বলে (ডাকনাম) চেনে, মনোনয়ন পর্ব থেকেই ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়ে দিলেন। বোমা, গুলি, ছুরির অবাধ ব্যবহার জেলাকে যখন প্রায় বিরোধীশূন্য (বিরোধী বলতে প্রধানত বিজেপি) করে তুলেছে, তখনই কেষ্ট ‘উন্নয়নের’ গান গাইতে শুরু করেন। বলেন, ‘রাস্তায় দাঁড়ালেই উন্নয়ন। ডাইনে উন্নয়ন, বাঁয়ে উন্নয়ন, সামনে উন্নয়ন, পেছনে উন্নয়ন।’ উন্নয়নের এই ঢক্কানিনাদে কী করে চুপ করে থাকেন শঙ্খ ঘোষ। ‘মুক্ত গণতন্ত্র’ নামে এক কবিতা লিখলেন। তার কিছু পঙ্‌ক্তি এই রকম, ‘...যথার্থ এই বীরভূমি—/ উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে এসে/ পেয়েছি শেষ তীরভূমি। দেখ খুলে তোর তিন নয়ন/ রাস্তাজুড়ে খড়্গ হাতে/ দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন...।’

মমতা বলেছিলেন, কেষ্টর মস্তিষ্কে অক্সিজেন কম যায়। তাই মাঝেমধ্যে অস্বাভাবিক কিছু বলে ফেলেন ও করে ফেলেন। অক্সিজেন কম যাওয়ার দরুনই কি না কে জানে, সাহিত্য একাডেমি ও জ্ঞানপীঠ পুরস্কার বিজেতা পদ্মভূষণ সম্মানপ্রাপ্ত ৮৬ বছর বয়সী কবির লেখা কবিতার জবাব কেষ্ট দিলেন এইভাবে, ‘কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছি, নজরুলের নাম শুনেছি। কিন্তু শঙ্খ? এ আবার কোন কবি?’ কেষ্ট বলেই চললেন, ‘শঙ্খ খুবই পবিত্র। তাঁর ধ্বনি পবিত্র। উনি শঙ্খের নাম অপমান করেছেন।’

কেষ্টকে কটাক্ষ করা তো দূরের কথা, তৃণমূল কংগ্রেস বরং শঙ্খ ঘোষকেই দোষী ঠাউরে বলেছে, কবিতাটা ব্যক্তি বিশেষকে আঘাত দিয়ে লেখা। বঙ্গবাসী হতবাক!

পশ্চিমবঙ্গের মতো পঞ্চায়েত দখলে আর কোনো রাজ্যে এমন মরিয়া ভাব দেখা যায় না। পঞ্চায়েত দখলের প্রচেষ্টা কেন এত প্রবল? অবধারিত এই প্রশ্ন উঠেই চলেছে।

অনুব্রত মণ্ডল। ছবি: সংগৃহীত
অনুব্রত মণ্ডল। ছবি: সংগৃহীত

প্রথম কারণ সেই তত্ত্ব, যা লেখার শুরুতেই বলেছি। গ্রাম জিতে রাজ্য জেতো। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছিল ২০০৮ সালে। সিপিএমের অস্ত্রে তাদের বধ করার ছক তৃণমূল তখনই নিয়েছিল। তারপর থেকে শুধুই জয় ধরে রাখার খেলা। তৃণমূল যত ক্ষমতাবান হয়েছে, ততই দুর্বল হয়েছে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা। বিরোধীদের স্থান ক্রমে দখল করার মতো অবস্থায় চলে এসেছে বিজেপি। এই মুহূর্তে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী শক্তি। ত্রিপুরা জয়ের পর বিজেপি সম্পর্কে তৃণমূল কংগ্রেস আরও বেশি সতর্ক। তাদের রাজ্য নেতৃত্ব ‘ইটের বদলে পাটকেল’ নীতি প্রকাশ্যে গ্রহণ করেছে। তৃণমূল বুঝেছে, ভয় পেলে চলবে না। তাদের অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে হবে। ‘শোলে’ সিনেমার সেই বিখ্যাত ডায়ালগ মেনে তারা রুখে দাঁড়িয়েছে। কারণ, গব্বর সিংয়ের কথায়, ‘যো ডর গয়া, সমঝো মর গয়া।’

পশ্চিমবঙ্গে শিল্প নেই। যে অর্থে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক কিংবা পাঞ্জাব শিল্প প্রধান রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ তা নয়। রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র যখন ফিকি বণিকসভার সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন, সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের এক খবরের কাগজে লিখেছিলেন, ‘রাজ্যে শিল্প বলতে একটাই, গৃহনির্মাণশিল্প।’ এই অসচ্ছল রাজ্যে রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকতে গেলে যে সম্পদ প্রয়োজন, তার উৎস তা হলে কী? পদগুলো দখলে রাখা। পদ দখলে থাকলে অর্থ ব্যয়ের সুফল আসে। কাটমানি পকেটে ঢোকে। চাঁদাবাজি, তোলাবাজি সহজতর হয়। জীবন দিয়ে যারা ভোটে তরাবে, তাদের দেখাশোনা নেতাদেরই কাজ। নেতার হাতে টাকা না থাকলে ক্যাডার পোষা বড় দায়।

অর্থের আমদানি কিন্তু কম নয়। নির্বাচনী কেন্দ্রের উন্নয়নে রাজ্যের সাংসদেরা বছরে পান পাঁচ কোটি টাকা। দুষ্টু লোকেরা বলে, প্রকল্প যা-ই হোক, কাটমানি অন্তত ১০ শতাংশ। বিধায়কেরা পান বছরে দুই কোটি করে। বিকেন্দ্রীকরণের জন্য পঞ্চায়েতগুলোয় কেন্দ্র ও রাজ্য যা খরচ করে, পদ দখলে থাকলে তারও নিয়ামক ও নিয়ন্ত্রক পার্টি। কোষাগারের এই চাবি ট্যাঁকে গুঁজে রাখা তাই এতটাই জরুরি।

গ্রাম পঞ্চায়েত দখলে থাকলেই পঞ্চায়েত সমিতি দখলে আসবে। সমিতি দখলে রাখা মানে জেলা পরিষদে ক্ষমতায় থাকা। জেলার দখল এনে দেয় রাজ্য। পঞ্চায়েত হলো মোটরগাড়ির ফার্স্ট গিয়ার। গাড়ি গড়ানোর ওটাই প্রথম শর্ত। তার দখল না ছাড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে বঙ্গীয় রাজনীতির অলিখিত শর্ত। বিহার, ঝাড়খন্ড, হরিয়ানা বা উত্তর প্রদেশকে সরিয়ে নির্বাচনী সহিংসতায় পশ্চিমবঙ্গ তাই এক নম্বরে।

অনুব্রত মণ্ডল অথবা আরাবুল ইসলামদের কদর তাই এতটাই।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লির প্রতিনিধি