স্থগিতাদেশ ও খারিজ নিয়ে কিছু কথা

অনেকটা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মতোই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন উচ্চ আদালতের রায়ে স্থগিত হয়েছিল। তফাতটি হলো, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়নি, গাজীপুরের নির্বাচনে প্রার্থিতা চূড়ান্ত হয়েছিল, নির্বাচনের বাকি ছিল আর মাত্র ৯ দিন। প্রার্থীদের প্রচারণা তুঙ্গে উঠেছিল। ফলে ওই এলাকার সাধারণ মানুষ, প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এক দিন পরই বিএনপির প্রার্থী হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীও এক দিন পর আপিলে যুক্ত হয়েছেন।

এই স্থগিতাদেশের পরপরই নির্বাচন কমিশন জানায়, এ বিষয়ে তারা কিছু জানত না, এমনকি আদালত থেকেও তাদের কাছে কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়নি। ঢাকা উত্তরের বেলায়ও কমিশনের কাছ থেকে একই রকমের বক্তব্য পাওয়া গিয়েছিল। অনেক পরে নির্বাচন কমিশন আপিল করেছে, কিন্তু তার চূড়ান্ত ফলাফল আজও পাওয়া যায়নি। অবশ্য গাজীপুরের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে তৎপর দেখা গেছে, তিন দিন পরই আপিল করেছে। আমার জানামতে, বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এবারই প্রথম তিন পক্ষ-সরকারি দল, বিরোধী দল ও নির্বাচন কমিশন একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছে।

২০১১ সালে এ টি এম শামসুল হুদা কমিশনের সুপারিশে সংবিধানে নতুনভাবে ১২৫ (গ) অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছিল, যাতে নির্বাচন চলাকালে আদালতের রায়ে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত না হয়। সুপারিশটি ভারতের অনুরূপ করা হয়েছিল। ভারতে নির্বাচন-প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আদালত অভিযোগের শুনানি করেন না। নির্বাচনের পর শুনানি হয়, অভিযোগ প্রমাণিত হলে আদালত ওই নির্বাচন আংশিক অথবা পূর্ণাঙ্গভাবে বাতিল করতে পারেন। বাংলাদেশের সংবিধানে আংশিক সংযোজন করে অভিযোগ বা রিট গ্রহণ করার ব্যবস্থা রাখায় উচ্চ আদালত রিট গ্রহণ বা খারিজ করতে পারেন। এ ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশনকে নোটিশ পাঠানো এবং শুনানি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৫ (গ)-এ বলা হয়েছে, ‘কোনো আদালত, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হইয়াছে এইরূপ কোনো নির্বাচনের বিষয়ে, নির্বাচন কমিশনকে যুক্তিসংগত নোটিশ ও শুনানির সুযোগ প্রদান না করিয়া, অন্তর্বর্তী বা অন্য কোনোরূপে কোনো আদেশ বা নির্দেশ প্রদান করিবেন না।’

আলোচিত দুটি ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের তথ্য মোতাবেক নোটিশ বা শুনানি করা হয়নি। উভয় ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীর উপস্থিতির কথা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলেও উভয় ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন তাদের আইনজ্ঞকে ওই রিটের শুনানির জন্য ওকালতনামা দেয়নি বলে পত্রপত্রিকায় প্রকাশ। প্রশ্ন হলো, আদালত বা আদালতের পক্ষ থেকে লিখিত আদেশ ছাড়া নির্বাচন কমিশন নির্বাচন স্থগিত করতে বাধ্য কি না? লিখিত আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশন তার সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে-এই মর্মে রিট খারিজ করতে সুপ্রিম কোর্টে তাৎক্ষণিকভাবে আপিল করতে পারত কি না? অভিজ্ঞতার আলোকে এবং সংবিধান ও আইনের সরল পাঠে মনে হয় যে আদালত থেকে সংক্ষিপ্ত আদেশ পাওয়ার পরই শুধু নির্বাচন কমিশন আদালতের আদেশ কার্যকর করে থাকে এবং নোটিশ ও শুনানি না পেলে ওই আদেশের বিপরীতেই আপিল করা যায়। পূর্ণাঙ্গ রায়ের অথবা সংক্ষিপ্ত রায়ের অপেক্ষায় সময়ক্ষেপণ হয় মাত্র।

আলোচিত দুটি স্থগিত নির্বাচন স্থানীয় সরকারের নির্বাচন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে তুলনীয়। তবু স্থানীয় সরকার নির্বাচনও আইনত নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। তাই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮ থেকে ১২৬ পর্যন্ত প্রদত্ত ক্ষমতা ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সব অধিকারই জাতীয় থেকে স্থানীয়-সব নির্বাচনের জন্য প্রযোজ্য। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা পরিচালনা করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়; ফলে নির্বাচন কমিশন এসব নির্বাচনের আগে সীমানাবিষয়ক জটিলতা, চলমান মামলা ও সেগুলোর নিষ্পত্তি ইত্যাদি বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে, মতামত নেয়। সীমানাবিষয়ক জটিলতার কারণেই বেশির ভাগ নির্বাচন আটকে থাকে। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর সীমানা নির্ধারণ-পুনর্নির্ধারণের এখতিয়ার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। এ বিষয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলে তার নিষ্পত্তি হয় আদালতের মাধ্যমে। কিন্তু জাতীয় সংসদের আসনের সীমানা নির্ধারণ-পুনর্নির্ধারণ নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্বের অন্যতম। কারণ, সীমানা নির্ধারণের কাজটি আদালতের এখতিয়ারভুক্ত হলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মতো জাতীয় নির্বাচনও ব্যাহত হতে পারে। নির্বাচন কমিশনকে এই দায়িত্ব দেওয়ার বিধান শুধু বাংলাদেশের সংবিধানেই নয়, উপমহাদেশের সব দেশের সংবিধানেই আছে।

তবে সাংবিধানিক নিশ্চয়তার পরও শঙ্কা থেকেই যায়। ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে কমিশনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হলে আদালত তা গ্রহণ করেছিলেন। পরে নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী সংবিধানের এখতিয়ারের বিষয়টি তুলে ধরলে রিটটি খারিজ হয়ে যায়। লক্ষণীয়, এ বিষয়ে রিট গ্রহণ করা উচ্চ আদালতের এখতিয়ারবহির্ভূত-এ কথা সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে থাকা সত্ত্বেও আদালত তা গ্রহণ করেছিলেন এবং নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করার নোটিশ দিয়েছিলেন। ফলে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। ভবিষ্যতেও এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থেকে যায়। কারণ, সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে উচ্চ আদালতের রিট গ্রহণের এখতিয়ারের ব্যাখ্যা নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞের বিভিন্ন ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে।

সংবিধানের ১২৫ (ক) ও (গ) অনুচ্ছেদ নিয়ে এক টেলিভিশন টক শোতে কিছুদিন আগে অবসরপ্রাপ্ত আপিল বিভাগের এক বিচারপতি বলেন, ‘কোনো আদালত’ বলতে উচ্চ আদালত বোঝাবে না, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালসহ নিম্ন আদালত বোঝাবে। তিনি আরও বলেন, সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে রিট গ্রহণের যে এখতিয়ার দেওয়া আছে, তা এই দুই অনুচ্ছেদের জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে। এ ব্যাখ্যায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমানা পুনর্নির্ধারণের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হলে গাজীপুরের মামলার মতো ওই নির্বাচনও ঝুলে যেতে পারে।

আমাদের সংবিধানের এসব অনুচ্ছেদ ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২৯ (এ)-এর অনুরূপ। ভারতীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনী আসনগুলোর সীমানা পুনর্নির্ধারণ সম্পন্ন করা হয় সংবিধানের আলোকে একটি আইনের মাধ্যমে আলাদা কমিশন দ্বারা। ওই সংবিধানেও আমাদের সংবিধানের ১২৫ (ক)-এর অনুরূপ অনুচ্ছেদ দ্বারা এ দায়িত্ব আদালতের এখতিয়ারবহির্ভূত রাখা হয়েছে। অবশ্য ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২২৬ অনুচ্ছেদ দ্বারা উচ্চ আদালতকে রিট গ্রহণের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। আমাদের সংবিধানের ১০২ ও ভারতীয় সংবিধানের ২২৬ অনুচ্ছেদ প্রায় অনুরূপ। ওই অনুচ্ছেদেও ‘কোনো আদালত’ (Any court) উল্লেখ রয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের আওতায় লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভার সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে করা কয়েকটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে উচ্চ আদালত কর্তৃক এ ধরনের রিট গ্রহণের ওপর মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট মতামত দিয়েছিলেন যে,২২৬ অনুচ্ছেদে হাইকোর্টের ব্যাপক এখতিয়ার থাকলেও ভারতীয় সংবিধানের পূর্বোল্লিখিত ৩২৯ (এ) অনুচ্ছেদে এ ধরনের রিট গ্রহণ এখতিয়ারবহির্ভূত করা হয়েছে। অবশেষে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে সুপ্রিম কোর্ট আপিলটি খারিজ করে হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন (মেঘরাজ কোঠারি বনাম ডিলিমিটেশন কমিশন ও অন্যরা; এআইআর ১৯৬৭ এসএসসি ৬৬৯; Meghraj kothari v Delimilation Commission and ors Air 1967 sc 669)। এসব সত্ত্বেও ২০০৮ সালে আমাদের উচ্চ আদালত সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিপরীতে রিট গ্রহণ করেছিলেন এবং শুনানিতে রিট খারিজ হলেও নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছুদিন অনিশ্চয়তা ছিল। কাজেই এই আলোচনা এবং আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতির ব্যাখ্যা ভবিষ্যতের জন্য শঙ্কা তৈরি করে।

গাজীপুর ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তফসিল ঘোষণার পর আবেদন অনুচ্ছেদ ১২৫ (ক)-এর আওতায় না পড়লেও ১২৫ (গ)-এর আওতায় রিট গ্রহণ করে নির্বাচন কমিশনকে নোটিশ না দিয়ে এবং শুনানি ছাড়াই নির্বাচন স্থগিত করায় নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। অবশ্য আপিল বিভাগ হাইকোর্টের গাজীপুর নির্বাচনের স্থগিতাদেশ বাতিল করে আগামী ২৮ জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু ঢাকা উত্তরের নির্বাচনের ভবিষ্যৎ পরিষ্কার নয়। এ ধরনের অধিকাংশ রিট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে থাকে।

যা হোক, আশা করি, সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে উচ্চ আদালত ও নির্বাচন কমিশনের জন্য এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকবে, যা ভবিষ্যতের জন্য অনুসরণীয় হবে।

এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক
[email protected]