কোটার কাঁটা, ধর্মঘট ও অধরা প্রজ্ঞাপন

সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ আজ রোববার বেলা একটায় সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, বিকেল পাঁচটার মধ্যে কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন প্রকাশিত না হলে আগামীকাল সোমবার সকাল ১০টা থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্র ধর্মঘট ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন আন্দোলনকারীরা। এই সময় সব পরীক্ষা ও ক্লাস বর্জনেরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

সংগঠনটির যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে আসছি। ৩২ দিন পার হলেও এখনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। আমাদের সঙ্গে সরকার ওয়াদা করেছে, ৭ মের মধ্যে প্রজ্ঞাপন হবে। কিন্তু সেই প্রজ্ঞাপন এখনো জারি করা হয়নি।’ ছাত্ররা কারও প্রতিপক্ষ নয়—এমনটা জানিয়ে নুরুল হক বলেন, ‘এই প্রজ্ঞাপন জারি হলে কোনো ছাত্র আর রাজপথে থাকবে না। আমরা আনন্দ মিছিল বের করব। তাই আজ বিকেল পাঁচটার মধ্যে কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি না হলে আমরা আমাদের ঘোষিত কর্মসূচি পালন করব।’

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, এর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বের হয়ে শহীদ মিনার, কার্জন হল, হাইকোর্ট, মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগে প্রবেশ করে। পরে রাজু ভাস্কর্যের সমনে এসে শেষ হয়। এ সময় বৃষ্টি এলে শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির মধ্যেই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে থাকেন। চট্টগ্রামে তাঁরা ষোলশহর রেলস্টেশনে কর্মসূচি পালন করেছেন।

একটি বিষয় আমরা বুঝতে অপারগ, যেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা বলেছেন, তাঁরা সরকারের প্রতিপক্ষ নন, সরকার সেই তরুণদেরই প্রতিপক্ষ ভাবছে কেন? এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সমস্যাটি ঝুলিয়ে রেখেছে তারা। তরুণদের প্রতি সরকার এত অসংবেদনশীল হলো কীভাবে? এই তরুণেরা ক্ষমতায় যেতে চান না। তাঁরা কোনো বিষয়ে সরকারকে চ্যালেঞ্জও করেননি। তাঁরা চান লেখাপড়ার পর যেন মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে একটি চাকরির নিশ্চয়তা। এটা ন্যায্য দাবি।

সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের এই আন্দোলন প্রসঙ্গে স্বাধীনতার পরের একটি ঘটনার কথা মনে পড়েছে। ঘটনাটি অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের কাছে শোনা। সম্ভবত তিনি কোথাও লিখেছেনও ঘটনাটি। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল শিক্ষার্থী পরীক্ষা ছাড়াই পাস করিয়ে দেওয়ার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে ঘেরাও করেছিলেন। কেউ একজন বঙ্গবন্ধুকে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন। তিনি নিজে পুরোনো গণভবন থেকে রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে এসে উপাচার্য মহোদয়কে উদ্ধার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পরীক্ষা দিয়েই পরের শ্রেণিতে উঠতে হবে। অটো প্রমোশন হবে না। হয়নি।

সেই তরুণেরা অন্যায় দাবি করেছিলেন। আর আজকের তরুণেরা ন্যায়ের দাবিতে আন্দোলন করছেন। তাঁরা কোটা বাতিলের কথা বলেননি। বলেছিলেন সংস্কারের কথা। অর্থাৎ বর্তমানে ৫৬ শতাংশ কোটা আছে, সেটি যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা। এরপর একজন মন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে বসলেন। প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা থাকবে না বলে ঘোষণা দিলেন। কিন্তু কোটার কাঁটা আগের জায়গায়ই রয়ে গেল।

কী হবে আগামীকাল? সরকার দাবি মেনে নিলে শিক্ষাঙ্গনে ধর্মঘট হবে না। না মানলে, অর্থাৎ প্রজ্ঞাপন জারি না করলে কী হবে, সেটি জানার জন্য আমাদের কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে শিক্ষার্থীদের কোনোভাবেই আইন নিজের হাতে নেওয়া চলবে না। তাতে তাদের ন্যায্য দাবি যৌক্তিকতা হারাবে।

তরুণেরা যে আন্দোলন করছেন, কাউকে ক্ষমতা থেকে নামাতে বা ওঠাতে নয়। তাঁরা আন্দোলন করছেন মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে একটি চাকরির সুযোগ পাওয়ার জন্য। তাঁরা এও জানেন যে কোটা সমস্যার সমাধান হলেও এখন বাংলাদেশে যে লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার আছেন, তাঁদের স্বল্পসংখ্যকই চাকরি পাবেন। বেশির ভাগ বঞ্চিতই থাকবেন। কিন্তু তাঁদের আন্দোলন একটি নীতিগত অবস্থান থেকে।

এই আন্দোলনে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা আছেন। শহীদ পরিবারের সন্তানেরা আছেন। বেশ কয়েক দিন আগে পত্রিকায় দেখেছিলাম, একজন তরুণ বাবার নাম-পরিচয় দিয়ে বলেছেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, কিন্তু আমি কোটায় চাকরি চাই না। মেধায় চাকরি চাই।’

এটাই একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের অহংকার।

সরকার কোটা সমস্যার সমাধান কীভাবে করবে, এখনো পরিষ্কার নয়। শুধু বলা হয়েছে, জনপ্রশাসন সচিবের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু সেই কমিটির কার্যবিধি কী হবে, কত দিনে তারা সুপারিশ করবে, সরকার সেই সুপারিশ কীভাবে বাস্তবায়ন করবে, সবকিছুই অস্পষ্ট।

আমরা আশা করব, সরকার কোটার বিষয়ে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেবে; যাতে আগামী কাল থেকে শিক্ষার্থীদের ধর্মঘটে যেতে না হয়।

সম্প্রতি খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, তরুণেরা জয়-পরাজয় নির্ধারণ করবেন। শুধু সিটি করপোরেশন নির্বাচন নয়, জাতীয় নির্বাচনেও তাঁরা হবেন নিয়ামক শক্তি। তাহলে তরুণদের সর্বজনীন দাবিকে সরকার উপেক্ষা করছে কেন?

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে কোটা বাতিলের বিষয়ে বললেন, এই বিষয়ে গেজেট প্রকাশের জন্য আন্দোলনের হুমকি—এটা সমীচীন নয়। শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত দাবির ব্যাপারে সরকার সহানুভূতিশীল। যৌক্তিক সমাধানের সব রকম চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

লেখাটি যখন শেষ পর্যায়ে, তখনই প্রথম আলোর অনলাইনে দেখলাম, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরতে বলেছেন। সেই সঙ্গে অবিলম্বে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু তিনিই তো বলেছিলেন এক মাসের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে। সেই এক মাস আগেই পার হয়ে গেছে।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]