বঙ্গবন্ধু-১ উপগ্রহটি আমরা কী কী কাজে লাগাতে পারি

তিন-চার দিন ধরে চরম আনন্দ এবং হইচইয়ের পরে বঙ্গবন্ধু-১ ঠিকঠাক উড়ে যেতে দেখে আমাদের আনন্দময় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান ঘটেছে! মাসখানেকের মধ্যেই আমরা উপগ্রহটি ব্যবহার শুরু করতে পারব। এটা যেমন আনন্দ এবং গর্বের ব্যাপার, তেমনি মর্যাদারও ব্যাপার। বাংলাদেশের মানুষের মহাকাশ ছোঁয়ার এই সফলতার গল্পটি আমাদের গণমাধ্যমগুলো তুলে ধরার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে।

তবে আমার মনে হয়েছে, যতটা দরকার ছিল, তার অনেক কিছুই তুলে ধরা যায়নি। কারণ, মহাকাশবিজ্ঞানের অত্যাধুনিক ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের মাঝে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই আমরা আবেগপ্রবণ খোঁচাখুঁচিতে বেশি ব্যস্ত ছিলাম। আমাদের মেধা ও উদ্‌যাপনের সিকি ভাগও ব্যয় করে যদি গুগল ঘেঁটে বুঝতে চেষ্টা করতাম, এই উপগ্রহটি আসলে কী যন্ত্র, কীভাবে কাজ করে, এর দ্বারা কী কী সেবা পাওয়া সম্ভব, আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো কোন কোন জায়গায়, বর্তমান পরিস্থিতি মেনে নিয়ে সেগুলো কীভাবে কাটানো যাবে, তাহলে ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে আরও মর্যাদা দেওয়া হতো। যা-ই হোক, এ সীমাবদ্ধতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়ে দ্রুত উপগ্রহের সর্বোচ্চ ব্যবহার করাটা শিখে নেওয়া দরকার।
আমি নিজেও মহাকাশবিজ্ঞান বা সেই সংশ্লিষ্ট কোনো প্রকৌশলী বা বিজ্ঞানী নই। তাই সবার আগে আমার সীমাবদ্ধতাটুকু বলে নিই। বঙ্গবন্ধু-১ উপগ্রহের খুঁটিনাটি ক্ষমতা সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো জ্ঞান আমার নেই। ইন্টারনেটেও সেগুলো এখনো পৌঁছায়নি। মানুষের তৈরি উপগ্রহ সম্পর্কে আর দশজন বাঙালির যে সাধারণ জ্ঞান, সেটুকুই আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

ক. আজকাল প্রায় প্রতিদিনই মহাকাশে কিছু না কিছু পাঠানো হচ্ছে। পাঠানোর খরচ কমে যাওয়া, ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি ছোট ছোট উপগ্রহ তৈরি এবং পাঠানোর সক্ষমতা তৈরি হওয়ায়, ইতিমধ্যেই গমগমে একটা বাজার তৈরি হয়েছে। ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী মোট ৭ হাজার ৯০০টির মতো বস্তু মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। যার ভেতরে গত বছরই পাঠানো হয়েছে ৩৫৭টি। প্রথম থেকে পাঠানো উপগ্রহগুলোর বেশ কয়েকটিই আজ আর সচল নেই। অচলগুলো মহাকাশের বিভিন্ন কক্ষপথেই পড়ে আছে। গত বছরের হিসাব অনুযায়ী সচল উপগ্রহের সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৭৩৮।

খ. সেবা, অবস্থান, প্রযুক্তি ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এদের ভাগ করা হয়। যেমন: যোগাযোগ উপগ্রহ, পৃথিবী পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা উপগ্রহ, মহাকাশ পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা উপগ্রহ, প্রযুক্তি উন্নয়ন উপগ্রহ, অবস্থান নির্ণয়ন উপগ্রহ, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা উপগ্রহ ইত্যাদি। এরা পৃথিবী থেকে বিভিন্ন দূরত্বে প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট আলাদা আলাদা কক্ষপথে অবস্থান করে।
গ. এদের ভেতরে ভূ-স্থির উপগ্রহগুলো পৃথিবী থেকে ৩৫ হাজার ৭৮০ কিলোমিটার উঁচুতে ঘণ্টায় ১১ হাজার কিলোমিটার গতিতে ঘুরতে থাকে। পৃথিবীর সমান গতিতে, পৃথিবীর মতোই ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে ঘোরে, তাই পৃথিবী থেকে একে দেখতে স্থির মনে হয়।
ঘ. একটা ভূ-স্থির উপগ্রহ পৃথিবীর ৪০ শতাংশ জায়গা কভার করতে পারে। মানে ৩টি উপগ্রহ দিয়ে সারা পৃথিবীর ছবি তোলা বা যোগাযোগ রক্ষার কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়।
ঙ. ভূ-স্থির উপগ্রহ দিয়ে মূলত আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা আরও সহজ ও নির্ভরযোগ্য করা যায়। পৃথিবীপৃষ্ঠের নিখুঁত ও বিস্তারিত ছবি তোলা যায়।
চ. পৃথিবীর উপরিভাগের পরিবর্তনের তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ করা যায়।
ছ. দুর্যোগের আগে, দুর্যোগের সময় ও দুর্যোগ-পরবর্তী যোগাযোগব্যবস্থা নিবিড় ও নিরবচ্ছিন্ন করা যায়।

বঙ্গবন্ধু-১ ভূস্থির উপগ্রহ দিয়ে আমরা কী কী কাজ করতে পারব

ক. কম খরচে আরও বেশিসংখ্যক টেলিভিশন চ্যানেল দেখতে পারব। টেলিভিশন সেট ভালো থাকলে আরও ভালো মানের ভিডিও দেখতে পাব।
খ. বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের গতিবিধি আরও আগাম আরও নিখুঁতভাবে জানতে পারব। উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রস্তুতি নিতে পারায় গত পাঁচ বছরে ঘূর্ণিঝড়গুলো আগের মতো ক্ষতি করতে পারেনি। এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও কমিয়ে আনা যাবে। দুর্যোগের সময়ও দুর্গমতম অঞ্চলে (যেমন: চরাঞ্চলে, মাছ ধরার ট্রলারে) মোবাইলের নেটওয়ার্ক থাকবে। বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে দুর্যোগকবলিত মানুষ উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে এবং উদ্ধারকর্মীরা সহজে ভুক্তভোগীকে খুঁজে ত্রাণ পৌঁছে দিতে পারবে।
গ. ঝড়ের আগের ছবি, পরের ছবির বিস্তারিত তুলনা করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে। ঠিক কোন গ্রামে কী ধরনের সহায়তা দরকার, তা দ্রুত বিশ্লেষণ করে সে অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।
ঘ. এখন একটা বাড়ি হেলে পড়লে চোখে দেখে বিচার করতে হয়। এই উপগ্রহের ছবির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে সামান্য হেলে পড়ার ঘটনাও ধরে ফেলা সম্ভব হবে। ফলে দুর্ঘটনা এড়ানো সহজ হবে বা দুর্ঘটনার ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হবে।
ঙ. ভূপ্রকৃতির সূক্ষ্ম পরিবর্তন যেমন: খাল-বিলে পানির উচ্চতা, নদীর নাব্যতার তথ্য আরও নিখুঁতভাবে পাওয়া যাবে। এসব তথ্য ব্যবহার করে বন্যার ব্যাপ্তি, সে অনুযায়ী প্রস্তুতি, বন্যা–পরবর্তী সময়ে কোন জমি কবে নাগাদ ফসলের জন্য আবার উপযোগী হবে, তা নির্ধারণ করা সহজ ও বাস্তবসম্মত হবে।
চ. জলবায়ু পরিবর্তন বা মানুষের প্রভাবে পরিবেশের পরিবর্তন তথা বছরের পর বছর ধরে এলাকার বিল-খাল, রাস্তাঘাট, বসতভিটা, গাছগাছালির কী পরিবর্তন হচ্ছে, তা উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে সহজে বের করা যাবে। এই তথ্য ব্যবহার করে বাস্তবসম্মত পরবর্তী পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
ছ. রাস্তাঘাটের নিপুণ ডিজিটাল মানচিত্র করা সম্ভব হবে এবং সেই মানচিত্র মোবাইলে ব্যবহার করে যোগাযোগ দ্রুত এবং নিরাপদ করা সম্ভব হবে।
এ ছাড়া আরও অনেক উপকার এর থেকে পাওয়া যেতে পারে। এত দিন উপগ্রহের সেবা ব্যবহার শুধু মোবাইলে কথা বলা ও সামান্য ইন্টারনেটের ব্যবহারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। নিজেদের উপগ্রহ হওয়ায় একে দুর্যোগ-মোকাবিলা, যোগাযোগ ও কার্যকর গবেষণার অনেক কাজে ব্যবহার করা যাবে। বড় কথা উপগ্রহ এত দিন হাতে গোনা কিছু বিজ্ঞানী বা প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করতে পারত। এখন পদ্ধতি মেনে সাধারণ মানুষও উপগ্রহ থেকে তাৎক্ষণিক ছবি ও তথ্য পেতে পারবে। বঙ্গবন্ধু-১ উপগ্রহের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে একটা দক্ষ জনশক্তি দরকার। উপগ্রহের সেবা নেওয়ার জন্য যে জ্ঞানটা দরকার, সেটা তৈরি করা দরকার। যে চ্যালেঞ্জটা আজ থেকে আপনার-আমার কাঁধে এসে পড়ল।

গোলাম রব্বানী: পরিবেশবিষয়ক গবেষক, যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত