বনজঙ্গল কি আমাদের শত্রু?

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

স্টেডিয়ামের জন্য সংরক্ষিত বনের গাছ কাটা? সত্যিই বিচিত্র বললে কম বলা হয়, অদ্ভুত পাগলামির এই দেশ। খবরগুলো পড়া যাক একের পর এক: তিতাস গ্যাসের সঞ্চালন পাইপ লাইন নির্মাণের জন্য ১৩ হাজার ৩৫৬টি গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রিসভা। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিসট্রিবিউশন কোম্পানি এই পাইপ লাইন গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত নির্মাণ করবে। আমদানি তেল খালাসের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের টার্মিনাল এবং গাজীপুরের কাপাসিয়ায় মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য দুই জায়গায় সংরক্ষিত বনের ৩ হাজার ২৪৭টি গাছ কাটতে হবে।

অথচ ২০১৬ সাল এই মন্ত্রিসভাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ২০২২ সাল পর্যন্ত বনের গাছ কাটা যাবে না।

সুন্দরবনের পরে দেশের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন টেংরাগিরি। সুন্দরবনের পরে এখন এই বনের কাছেও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এবারের প্রক্রিয়াটি আরও এক কাঠি সরেস। কারণ, রামপাল সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দুরে হলেও টেংরাগিরির এক কিলোমিটারের মধ্যেই ৩০৭ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্তরাজ্য ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান মিলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে পিপিএ চুক্তি করেছে।

টেংরাগিরি একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। গত ১৫ বছর ধরে এই বনের অসংখ্য গাছ মরছে। কিন্তু এই ব্যাপারে বন বিভাগের কোনো উদ্যোগ নেই (প্রথম আলো, ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)। এর মধ্যেই আবার পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি না নিয়ে বনের এত কাছে হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ১০ কিলোমিটার প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা হওয়ার পরেও কীভাবে এক কিলোমিটারের মধ্যে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি মেলে? এ ছাড়া এখনো পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা হয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, প্রকল্পটি বনের এত কাছে, সেটা তাঁকে জানানো হয়নি। এই না জানার ফল কে ভোগ করবে? দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা, হুমকির মুখে পড়া বন, নাকি বন ধ্বংস হওয়ার ফলে যেই জনগোষ্ঠী বিপন্ন হবে তারা?

উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের সময়ে পরিবেশের কথা মাথায় রাখার অভ্যাস আমাদের এখনো গড়ে ওঠেনি। তাই মুখে মুখে শিকার করা হয়। আইনগতভাবেও স্বীকৃতি আছে। কিন্তু বাস্তবে তা মানা হয় না। সংবিধানে প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন আইন রয়েছে। কিন্তু সেগুলো মানার কোনো বালাই নেই। যেমন সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটারকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বলছে প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা। এই এলাকায় শিল্পকারখানা করা নিষিদ্ধ হলেও তা মানা হচ্ছে না। আমরা দেখছি সুন্দরবন দূষণের শিকার হচ্ছে। বনের চারপাশে রয়েছে শিল্পকারখানার ক্রমবর্ধমান চাপ।

শুধু সুন্দরবন কেন, বন ও গাছপালার সঙ্গে যেন আমাদের আদিম বৈরিতা! যশোর রোডের ঐতিহ্যবাহী গাছগুলো কাটা নিয়ে অনেক সমালোচনা-প্রতিবাদের পর গাছগুলো রেখেই রাস্তা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর পরে দেখেছি মানিকগঞ্জেও রাস্তা তৈরিতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। তবে সেখানে হাজার হাজার গাছ কেটেই রাস্তা করা হয়েছে। বন বিভাগ এ পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি একর বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে। এক বছরের মধ্যে আরও ১৬ হাজার একর বনভূমি বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান (প্রথম আলো, ২১ জানুয়ারি, ২০১৮)। এদিকে কক্সবাজারের মহেশখালীতে ১৯২ একর সংরক্ষিত বনভূমিতে জ্বালানি তেলের ডিপো তৈরি করার অনুমতি মিলেছে সরকারের তরফ থেকে। সেই ডিপো তৈরিতে কাটা পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে কয়েক হাজার গাছ। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি বন বিভাগও এই বিষয়ে আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।

তা ছাড়া মানবিক সংকটে পড়া রোহিঙ্গাদের জন্যও ৪ হাজার ৮৩ একর বনভূমিতে আশ্রয়শিবির গড়ে তোলা হয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। যেমন কুয়াকাটার ১ হাজার ১০০ একর বনভূমি এরই মধ্যে সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের তলদেশে পলি জমায় পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ঢেউয়ের মাত্রা হয়েছে বেশি তীব্র। তাই বনভূমি ধসে পড়ছে সমুদ্র গভীরে।

প্রাকৃতিক প্রতিবেশ বহু সম্পদে ভরপুর। এসব সম্পদ প্রান্তিক ও গরিব মানুষের কল্যাণে ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলে কার্যকরভাবে দারিদ্র্য কমানো যায়। তবে এসব সম্পদে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া সব মানুষের গরিবি হাল দূর করা যাবে না। কিন্তু তার আগে প্রাকৃতিক প্রতিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু সামগ্রিক কার্যক্রম দেখলে মনে হয় বন ও গাছপালাসহ প্রাকৃতিক প্রতিবেশ বাঁচিয়ে রাখায় আমাদের তেমন কোনো মনোযোগ নেই।

স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে আমরা বের হয়ে আসছি। তবে মনে রাখতে হবে যে এটা একটা গড় অবস্থান। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃত পাওয়ার মানে এই নয় যে দেশের সব দরিদ্র মানুষ এর সুফল পাবে। তা না হওয়ার কারণ হলো ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য। তাই সার্বিকভাবে জনগণের উন্নয়ন ঘটাতে হলে অন্য বিষয়গুলো নিয়েও ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে অন্য বিষয়গুলোর পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রতিবেশের সম্পদ কাজে লাগানোর কথা ভাবতে হবে। পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমেও দারিদ্র্য বিমোচন ঘটাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা যায়। প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা এর পূর্বশর্ত।

প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে যেসব সুবিধা আমরা পেয়ে থাকি সেগুলোকে ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস বা প্রতিবেশগত পরিষেবা বলা হয়ে থাকে। এই ইকোসিস্টেম সার্ভিসগুলোর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ঘটানো সম্ভব বলে মনে করেন অনেক গবেষক। যুক্তরাজ্যের সরকার ২০১০ সালে ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস ফর পোভার্টি অ্যালিভিয়েশন (ইএসপিএ) বা দারিদ্র্য বিমোচনে প্রতিবেশগত পরিষেবা নামে একটি বৈশ্বিক গবেষণা কর্মসূচি শুরু করে। ইএসপিএর গবেষণা ফলাফল অনুযায়ী প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে যেসব সম্পদ আমরা পেয়ে থাকি, তা বেশি দিন পাওয়া যাবে না। প্রাকৃতিক পরিবেশের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলেই এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। ইএসপিএর বিজ্ঞানীরা বলছেন যে পরিবেশের ক্রমবর্ধমান অবনতির ফলে পরিবেশ-প্রতিবেশ হারিয়ে ফেলছে মানুষের কল্যাণ করার সামর্থ্য।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে অবস্থা দিন দিন আরও খারাপের দিকেই যাবে। পরিবেশদূষণ ও যথেচ্ছার খাল-বিল-নদী-নালা অবৈধভাবে দখল বাড়তেই থাকবে। সুতরাং যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে এবং প্রস্তাবিত আইনগুলো না মানলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। আর তা না করতে পারলে প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য মোকাবিলাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

তাই পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দুটোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই টেকসই উন্নয়নের প্রধান শর্ত। এ ছাড়া রয়েছে বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদে দরিদ্রদের অধিকার নিশ্চিতকরণের চ্যালেঞ্জ। সাধারণত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি যাদের আছে তারাই বন, জলমহাল, বালুমহালের মতো প্রাকৃতিক সম্পদগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেখানে অধিকার থাকে না। এই অধিকার নিশ্চিত করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তা করতে পারলে কার্যকর দারিদ্র্য বিমোচনের চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করা যাবে।

খলিলউল্লাহ্‌ প্রতিচিন্তার সহকারী সম্পাদক
[email protected]