২০০০ সালের আইনটি সংশোধন করুন

কঠোরতম শাস্তির বিধান রেখে প্রচলিত ফৌজদারি আইনের পাশাপাশি ২০০০ সালে প্রণীত হয়েছিল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন। দ্রুত সুবিচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু গত ১৮ বছরে নারীর প্রতি সহিংসতা তো কমেইনি, বরং বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিবেদন বলছে, ভয়াবহতা দিন দিন প্রকটতর হচ্ছে। আইনটি প্রয়োগে পদ্ধতিগত জটিলতা আছে। আছে প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও মামলার দীর্ঘসূত্রতা। খোদ আইনটিতেও রয়েছে বেশ কিছু অস্পষ্টতা, যার সংশোধন প্রয়োজন।

একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে, শুধু যৌতুকের জন্য ঘটানো সহিংসতা ছাড়া আইনটিতে পারিবারিক সহিংসতা অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে একজন নারী যদি সাধারণভাবে পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনে জখম হন, এমনকি মারাও যান, তিনি কিন্তু এই আইনের সুবিধা পাবেন না। অথচ বিভিন্ন জরিপ বলছে, দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার একটি বড় অংশই ঘটান পরিবারের সদস্যরা। এ আইনের ধারা-১১ যৌতুকের জন্য সাধারণ বা মারাত্মক জখম এবং মৃত্যু ঘটানো বা ঘটানোর চেষ্টার শাস্তি বিধান করেছে। ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা বলছেন, দ্রুত ও কার্যকর প্রতিকারের আশায় পারিবারিক সহিংসতার শিকার অধিকাংশ নারী এই ধারায় মামলা করেন। অথচ সহিংসতাটি হয়তো যৌতুকের জন্য ঘটানো হয়নি। ফলে ঘটনাগুলো ঢালাওভাবে মিথ্যা না হলেও অনেক মামলাই ‘মিথ্যা মামলা’ আখ্যা পাচ্ছে।

পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ২০১০ সালে একটি আইন করা হয়েছে। সেখানে প্রধানত কিছু দেওয়ানি প্রতিকারের কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া এখনো ওই আইনের কার্যকর প্রয়োগ দেখা যায় না। সুতরাং আপামর পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুরা কোনো বিশেষ আইনেই সুরক্ষা পাচ্ছে না। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পারিবারিক সহিংসতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হলে একটা সুরাহা হতে পারে। সেটা ‘মিথ্যা মামলা’র সংখ্যাও কমাতে পারে।

আইনটির ধারা-৯ ধর্ষণসংক্রান্ত অপরাধের শাস্তির বিধান করেছে। ধারাটি ব্রিটিশ আমলে করা দণ্ডবিধির ধর্ষণের ধারার সঙ্গে কিছু নতুন বিষয় সংযোজন করেছে। তবে মূল সংজ্ঞা হিসেবে দণ্ডবিধির সংজ্ঞাটিই বলবৎ রেখেছে। ফলে সেখানে যেসব ত্রুটি ও অস্পষ্টতা ছিল, অল্প কয়েকটি বিষয় ছাড়া এই আইনেও সেগুলো রয়ে গেছে। ধর্ষণের সংজ্ঞাটি একেবারেই সনাতনী ও সংকীর্ণ। বিশ্বের সমসাময়িক ধর্ষণসংক্রান্ত আইনগুলোতে অনেক ধরনের যৌন নির্যাতনকে ধর্ষণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। আমাদের আইনে সেগুলোর উল্লেখ নেই। দণ্ডবিধির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘যৌনসংগম’ বিবেচনা করার জন্য ‘প্রবিষ্ট করা’ই (পেনিট্রেশন) যথেষ্ট। কিন্তু ‘প্রবিষ্ট করা’ বলতে কী বোঝাবে, দণ্ডবিধি সেটার ব্যাখ্যা দেয়নি। আদালত এটাকে নারী-পুরুষের মধ্যে যৌনসংগমের প্রচলিত অর্থে ব্যাখ্যা করেন। ফলে পুরুষাঙ্গ ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ বা কোনো বস্তুর মাধ্যমে জোরপূর্বক ‘প্রবিষ্ট করা’ ধর্ষণের সংজ্ঞায় পড়ছে না।

দণ্ডবিধির সংজ্ঞায় ভুক্তভোগীর ‘সম্মতি’ শব্দটিরও কোনো ব্যাখ্যা নেই। অনেক ধর্ষণের মামলাতেই ভুক্তভোগীর সম্মতির প্রশ্নে শারীরিক বলপ্রয়োগের প্রমাণের ওপর খুব বেশি জোর দেওয়া হয়। অথচ সব সময় যে ভুক্তভোগীর শরীরে এর চিহ্ন থাকবে, তা নয়। অনেক সময় ‘সম্মতি’র ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আদালতের রায়ে ছাঁচে ঢালা কিছু ধারণার প্রতিফলন দেখা যায়। যেমন পুরুষকে ফাঁসানোর চেষ্টায় মিথ্যা অভিযোগ করা হয়, দরিদ্র ও বিবাহিত নারীরা বিশেষভাবে সন্দেহযোগ্য ইত্যাদি। ভারতের দণ্ডবিধিতে কিন্তু ২০১৩ সালে সংশোধন এনে ‘সম্মতি’র ব্যাখ্যা যুক্ত করা হয়েছে।

দণ্ডবিধি অনুযায়ী ধর্ষণের শিকার শুধু ‘নারী’ই হতে পারবেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ‘শিশু’ও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ‘প্রবিষ্ট করা’র ব্যাখ্যার অভাবে ছেলেশিশু ধর্ষণের শিকার হলে এ আইনে মামলা করা যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে মামলা হবে দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায়, ধর্ষণ নয়, ‘অস্বাভাবিক অপরাধ’ (আন-ন্যাচারাল অফেনস) হিসেবে। তবে ধর্ষণের সংজ্ঞায়নের সবচেয়ে নেতিবাচক দিক হচ্ছে, বিবাহিত স্ত্রী যদি ১৩ বছর বা তার বেশি বয়সের কোনো শিশু হয়, স্বামী তাঁকে ধর্ষণ করলে সেটা অপরাধ হবে না।
২০০০ সালের বিশেষ আইনটি ধর্ষণ গণ্য করার আইনানুগ বয়সসীমা দণ্ডবিধির ১৪ বছর থেকে বাড়িয়ে ১৬ বছর করা হয়েছে। অর্থাৎ ১৬ বছর বা তার কম বয়সী কারও ক্ষেত্রে ধর্ষণ গণ্য করতে সম্মতির প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু বিবাহিত স্ত্রীর ব্যাপারে দণ্ডবিধির দেওয়া সুযোগটি বহাল আছে। এ ধরনের একটি আইনি সংজ্ঞা নীতিগতভাবে আমাদের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা নির্যাতিত নারীকে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়াকেও বৈধতার সুযোগ করে দিচ্ছে।

দণ্ডবিধিতে সুস্পষ্টভাবে বলা নেই যে বিয়ের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করলে সেটাকে ধর্ষণ বলা যাবে। তবে ২০০০ সালের আইনে এর স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। আইনটির ধারা-৯ বলছে, ‘প্রতারণামূলকভাবে’ সম্মতি আদায় করে যৌনসংগম ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, বিয়ের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ‘সম্মতি’ নিয়ে সংগম করলে সেটা হবে ধর্ষণ। দেশটির সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ও এটা নিশ্চিত করেছে। তবে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের রায়গুলো সচরাচর এ ধরনের পরিস্থিতিকে ‘ধর্ষণ’ বলছে না।

ট্রাইবু ৵ নালও অনেক সময় এই পরিস্থিতিকে ধর্ষণ বলতে চান না। এসব ক্ষেত্রে সচরাচর একাধিকবার যৌনসংগমের নজির থাকে। এর ভিত্তিতে আদালত ধরে নেন, এতে নারীর সম্মতি ছিল। ধারাটিতে প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা সংযোজন করে সেখানে বিয়ের মিথ্যা আশ্বাসের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

আইনটির ধারা-১০ ‘যৌনপীড়ন’-এর শাস্তি বিধান করেছে। সেখানে দণ্ডবিধির যৌনপীড়ন বা যৌন হয়রানি-সংক্রান্ত ধারাগুলোর মতো নারীর ‘শ্লীলতাহানি’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু শব্দটির কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া যৌন পীড়ন তখনই হবে, যখন কেউ তা ‘যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে’ করবে। অভিযোগকারীকে প্রমাণ করতে হবে যে অপরাধীর এই উদ্দেশ্য ছিল এবং এর মাধ্যমে তার ‘শ্লীলতাহানি’ হয়েছে। এতে প্রমাণ করার দায়িত্ব গুরুভার হচ্ছে। যৌন অপরাধগুলোর সঙ্গে নারীর ‘চরিত্র’ জড়িত থাকার ধারণাও আরও বৈধতা পাচ্ছে। আইনটি প্রণয়নের সময় ১০ (খ) ধারায় যৌন হয়রানিকে বিশেষভাবে শাস্তিযোগ্য করা হয়েছিল। ২০০৩ সালের সংশোধনীতে সম্ভাব্য অপপ্রয়োগের যুক্তিতে এই ধারা বিলুপ্ত করা হয়। এখন আইনের কোথাও ‘যৌন হয়রানি’ নিয়ে কিছু বলা নেই। দেশে যৌন হয়রানির বর্তমান যে চিত্র, তাতে এই আইনে অপরাধটিকে বিশেষভাবে শাস্তিযোগ্য করাটা বাঞ্ছনীয়।

আইনটিতে ভুক্তভোগীকে চিকিৎসা ও ডাক্তারি পরীক্ষা করানো এবং সনদ দেওয়া বাধ্যতামূলক। চিকিৎসকের সাক্ষ্য দেওয়াকেও বাধ্যতামূলক করে বিধান সংযুক্ত করা উচিত। আইনে বিধি প্রণয়নের কথা থাকলেও এখনো কোনো বিধিমালা চূড়ান্ত হয়নি। বিশেষত, ডাক্তারি পরীক্ষা, সনদ তৈরি, ক্ষতিপূরণ আদায়ের মতো বিষয়গুলোতে বিস্তারিত বিধিমালা জরুরি। তবে শুধু আইনের সংশোধন বা কঠোরতম শাস্তি যথেষ্ট নয়। আইন প্রয়োগকারীদের দক্ষতা, সততা, জবাবদিহি এবং নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর প্রতি ন্যায়বিচার করার সদিচ্ছা ছাড়া ইতিবাচক পরিবর্তন আসা কঠিন।

তাসলিমা ইয়াসমীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক