যে সাক্ষাৎকার নিয়ে তোলপাড়

পাকিস্তান মুসলিম লীগ-এনের প্রতিষ্ঠাতা নওয়াজ শরিফ
পাকিস্তান মুসলিম লীগ-এনের প্রতিষ্ঠাতা নওয়াজ শরিফ

পাকিস্তানে নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ-এনের প্রতিষ্ঠাতা (যদিও আদালতের রায়ে তিনি দলীয় প্রধান পদ থেকে অপসারিত) নওয়াজ শরিফের একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রচণ্ড বিতর্ক চলছে। আর এই বিতর্কে রাজনীতিকদের পাশাপাশি গণমাধ্যম, সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষ জড়িয়ে পড়ছে। ১২ মে ইংরেজি দৈনিক ডন-এ নওয়াজের সাক্ষাৎকারটি ছাপা হওয়ার পরই শোরগোল শুরু হয়ে যায়।

পাঞ্জাবের মুলতানে ডন প্রতিনিধিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নওয়াজ এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের জন্য হজম করা কঠিন। রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘যদি দুটি বা তিনটি সরকার সমান্তরালে চলতে থাকে, তাহলে আপনি দেশ চালাতে পারবেন না। এটি বন্ধ হতে হবে। দেশে একটি সরকারই থাকবে, যা সংবিধানসম্মত।’

ওই সাক্ষাৎকারে নওয়াজ আরও যোগ করেন, পাকিস্তানি জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলো সক্রিয়; যাদের রাষ্ট্রবহির্ভূত কুশীলব বলা হয়। আমাদের কি উচিত তাদের সীমান্ত পার হতে এবং মুম্বাইয়ে ১৫০ জন মানুষকে হত্যা করতে দেওয়া? ওই হামলার ঘটনার বিচার প্রসঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কেন বিচার শেষ করতে পারলাম না। রাওয়ালপিন্ডির সন্ত্রাসবাদবিরোধী আদালতের বিচারই বা কেন থেমে গেল?’ উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে জঙ্গি হামলা চালিয়ে লস্কর-ই-তাইয়েবা ১৬৬ জন মানুষকে হত্যা করে। হামলাকারীদের মধ্যে আজমল কাশব ধরা পড়েন এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। পাকিস্তান তখন ওয়াদা করেছিল, হামলার সঙ্গে জড়িত পাকিস্তানি নাগরিকদের তারা বিচার করবে। নওয়াজের শেষ মন্তব্যটি ছিল ওই বিচার প্রসঙ্গেই।

তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে যাদের জন্য ‘যুদ্ধ’ করছি, সেটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। প্রেসিডেন্ট (রাশিয়ার) পুতিন এটি বলেছেন। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংও (চীন) একই কথা বলেছেন।’

নওয়াজ শরিফকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে তাঁর সরে যাওয়ার কারণ কী ছিল? তিনি সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈদেশিক নীতি টেনে এনে বলেন, ‘আমরা আমাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি। আমরা বিরাট ত্যাগস্বীকার করা সত্ত্বেও বহির্বিশ্ব আমাদের ব্যাখ্যা গ্রহণ করেনি। আফগানিস্তানের ব্যাখ্যাই তারা গ্রহণ করেছে। আমাদের এদিকে তাকানো উচিত।’ এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, জঙ্গিবিরোধী অভিযানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সদস্য জীবন দিয়েছেন।

তৃতীয় দফা ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়া সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে নওয়াজ বলেন, এ নিয়ে তাঁর কোনো অনুশোচনা নেই। এমনকি তিনি যদি ফের ক্ষমতায় ফিরে আসেন, আগের চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে না। তিনি বলেন, সংবিধানকে সবার ওপরে স্থান দিতে হবে। অন্য কোনো পথ নেই। পারভেজ মোশাররফের প্রতি ইঙ্গিত করে নওয়াজ বলেন, ‘দেখুন, আমরা একজন স্বৈরশাসকের বিচার করেছি। এর আগে কখনোই তা ঘটেনি।’

পুনরায় জেলে যাওয়ার চেয়ে বিদেশে নির্বাসিত জীবন বেছে নেবেন কি না, জানতে চাইলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৬৬ বছর বয়সের পর এসে আমি এটা কেন করব?’ বর্তমানে লন্ডনে ক্যানসারে চিকিৎসাধীন স্ত্রী কুলসুম নওয়াজের কাছে যেতে না পারার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ অবস্থায় দূরে থাকাটা সহজ নয়। তারপরও আমরা কোনো রেয়াত চাইনি।’

নওয়াজ শরিফের সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচন, মুসলিম লীগ নেতাদের চলে যাওয়া, ভাই ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ নওয়াজের ভাবমূর্তি ইত্যাদিসহ আরও অনেক বিষয় ছিল। কিন্তু শোরগোল দেখা দিয়েছে মুম্বাই হামলা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে জড়িয়ে তাঁর দুটি মন্তব্য নিয়ে। নওয়াজের সাক্ষাৎকার প্রকাশের কারণে সরকারের সংস্থাগুলোও ডন-এর ওপর আক্রমণ চালিয়েছে।

সরকার-নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তান প্রেস কাউন্সিল (পিপিসি) ইংরেজি দৈনিক ডন-এর সম্পাদকের কাছে নোটিশ পাঠিয়ে বলেছে, নওয়াজের সাক্ষাৎকার ছেপে পত্রিকাটি সংবাদপত্রের নীতিমালা ভঙ্গ করেছে। কিন্তু কোথায়, কীভাবে নীতিমালা ভঙ্গ করেছে, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি তারা। শুধু বলেছে, তাদের প্রকাশিত তথ্য বা মন্তব্য পাকিস্তান ও এর জনগণের জন্য অবমাননাকর হতে পারে এবং পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে খাটো করে থাকতে পারে। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সব কর্তৃত্ববাদী শাসকই গণমাধ্যমের লাগাম টেনে ধরতে এই অজুহাত খাড়া করে থাকেন।

প্রেস কাউন্সিলে ডন-এর সম্পাদকের কাছে নোটিশ পাঠানোর পর নিরাপত্তা বাহিনী বেলুচিস্তান ও সিন্ধুর বিভিন্ন শহরে ১২ মের ডন বিলি বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক স্থানেই পাঠক সেদিনের ডন পাননি।

অন্যদিকে পাকিস্তান প্রেস কাউন্সিলের নোটিশের প্রতিবাদ করেছে পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশন, পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)। মানবাধিকার কমিশন বলেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার ছেপে ডন পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা খর্ব করেছে-এ রকম কোনো প্রমাণ প্রেস কাউন্সিল দিতে পারেনি। তাদের মতে, এ ধরনের নোটিশ দেওয়া গণমাধ্যমের ওপর সরাসরি আক্রমণ এবং এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে আরও সংকুচিত করবে। পিএফইউজের সভাপতি আফজাল ভাট ও সাধারণ সম্পাদক আইউবজান শরহন্দির বিবৃতিতে গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের ওপর হস্তক্ষেপ না করার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বলেছে, শরিফের সাক্ষাৎকার সেনাবাহিনীকে অখুশি করেছে এবং তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে পত্রিকা বিলিতে বাধা দিয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে পাকিস্তানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার মাসেও গণতান্ত্রিক বিতর্ক চলতে দিতে তারা নারাজ। স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর যেকোনো ধরনের নাক গলানো বন্ধ করতে সংস্থাটি সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রচার চালানো হয় যে নওয়াজ শরিফ বিশেষ বিমান পাঠিয়ে ডন-এর সাংবাদিককে মুলতানে নিয়ে এসে সাক্ষাৎকার দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। ২২ মে ডন সম্পাদকীয় নিবন্ধে এই প্রচারকে ভুয়া খবর বা ‘ফেক নিউজ’ বলে সমালোচনা করেছে।

অন্যদিকে পাকিস্তান সামরিক-বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ সংস্থা জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি নওয়াজ শরিফের বক্তব্যের নিন্দা করেছে। সরকারি ও বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন সাংসদ মুম্বাই আক্রমণ নিয়ে নওয়াজের মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন। ডানপন্থী দলগুলো দেশদ্রোহের দায়ে তাঁর বিচার দাবি করেছে। তেহরিকই ইনসাফের প্রধান ইমরান খান বলেছেন, নওয়াজ মোদির (নরেন্দ্র মোদি) ভাষায় কথা বলে তাঁর (ইমরানের) দলের পক্ষেই নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন।

নওয়াজের সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর ভারতের গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার পায় যে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুম্বাই হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।

তবে নওয়াজের সাক্ষাৎকার ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকেও কিছুটা বেকায়দায় ফেলেছে। দলের একজন মুখপাত্র এক বিবৃতিতে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘নওয়াজের বক্তব্য গণমাধ্যমে মারাত্মক বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।’ সেনাবাহিনীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শাহিদ খাকার আব্বাসি জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক করেছেন। মুসলিম লীগপ্রধান ও নওয়াজের ভাই শাহবাজ বলেছেন, নওয়াজের সাক্ষাৎকারে এমন সব বক্তব্য এসেছে, যা তাঁদের দলের নীতির সমর্থক নয়।

তবে নওয়াজ শরিফ এসব প্রতিক্রিয়ায় খুব একটা ঘাবড়ে গিয়েছেন বলা যাবে না। তিনি পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমি সাক্ষাৎকারে যা বলেছি, তার কোথায় ভুল আছে?’ সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘স্থানীয় গণমাধ্যমে আমাকে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যাঁরা দেশ ও সংবিধানকে টুকরো টুকরো করেছেন, যাঁরা বিচারকদের গদি থেকে টেনে নামিয়েছেন, তাঁরা দেশপ্রেমিক?’ তিনি বলেছেন, ‘এ ব্যাপারে একটি কমিশন করা হোক, যার সামনে আমি ও আমাকে যাঁরা দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করছেন, তাঁরাও উপস্থিত থেকে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরবেন।’

কৌতূহলোদ্দীপক হলো, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে যখন নওয়াজ শরিফের সাক্ষাৎকার ছাপার জন্য ডন-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাঁর বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় চলছে, তখন তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল মুসলিম লীগই ক্ষমতায়। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে পাকিস্তানে একটি সরকার নেই। সেখানে একাধিক সরকারই সমান্তরালে দেশ চালাচ্ছে। অর্থাৎ পাকিস্তানে বরাবরের মতো সামরিক কর্তৃপক্ষ বেসামরিক সরকারের ওপর খবরদারি করছে।

পাকিস্তানের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকও মনে করেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে নওয়াজের অপসারণের পেছনেও সামরিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ছিল। পাকিস্তানের সত্তর বছরের ইতিহাসে পাকিস্তানে কোনো সরকারপ্রধানই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]