পাহাড়ের প্রতিদিনের শত্রু-মিত্র

দেশ এখন অনেকটাই নির্বাচনমুখী। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে আকাশ ঘুরে, চোখ নেমেছে গাজীপুর নির্বাচনে। মাঠে আছে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। চলছে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান। এসব ঘটনায় কিছুটা আড়াল হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক অস্থির ছবি। হত্যা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, অপহরণ সেখানকার গড়পড়তা চিত্র হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এর ধরন ও মাত্রা নতুন রূপ পেয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার প্রশাসন বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার থেকে একটু ভিন্ন। সেখানে প্রচলিত প্রশাসনের বাইরে বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতাকাঠামো ও প্রথাগত নেতৃত্ব (রাজা, হেডম্যান, কার্বারি) আছে, যারা দৃশ্যত খুব বেশি ক্ষমতার চর্চা করতে পারে না। জানুয়ারি মাসে হত্যার শিকার হন ইউপিডিএফের নেতা মিঠুন চাকমা। ইউপিডিএফ–সমর্থিত নারী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মন্টি চাকমা ও জেলা সাধারণ সম্পাদক দয়াসোনা চাকমার অপহরণ ও মুক্তি এবং পরে এ দুজনের অপহরণ মামলার দুই প্রধান আসামি অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা ও তপনজ্যোতি চাকমাকে হত্যা—ইত্যাদি ঘটনায় পাহাড় অঞ্চলে অস্থিরতা দেখা দেয়।

পাহাড়ে নানা ধরনের আধিপত্য বিস্তারের ঝোঁক বাড়ছে। আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলে প্রধানত ভূমি দখলকে কেন্দ্র করে। বিগত দুই দশকে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্ম; খোদ ত্রিপুরা–অধ্যুষিত এলাকা খাগড়াপুরের নাম বদল হয়ে হয়েছে ইসলামপুর। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থাকে শুধু পাহাড়ি-বাঙালি সীমাবদ্ধ পরিসরের মধ্য দিয়ে বিশ্লেষণ করা যাবে না।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তির বিরোধিতা করে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রসিত খীসার নেতৃত্বে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গঠন করা হয়। তখন থেকেই মূলত পাহাড়ে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ কিছুটা বদলে যায়। দুই দল ভাগ করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন ফেডারেশনকেও। শান্তিচুক্তি প্রশ্নে বিভক্ত হন পার্বত্য চট্টগ্রামকেন্দ্রিক বাঙালি লেখক, গবেষক ও অধিকারকর্মীরাও। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের গড়িমসি চলে, শুধু নির্বাচন এলেই চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের আশ্বাস শোনা যায়। শান্তিচুক্তির বছর দুয়েক পর নানিয়ারচর থেকে তিন বিদেশিকে অপহরণ করা হয়। প্রায় এক মাস পর মুক্তিপণের মাধ্যমে তাঁদের ছাড়া হয়। গত ২০ বছরে জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফের এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই দলের কোন্দলের কারণে বহু নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। পাহাড়ের এসব হত্যাকাণ্ডে সাধারণত পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয় না।

গত ২০ বছরে পাহাড়ে রাজনৈতিক ভাঙচুরও হয়েছে অনেক। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলে সংস্কারের যে চাপ ছিল, সেই একই ধরনের চাপে পাহাড়ের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতিতেও হঁাসফাঁস শুরু হয়। তখন সেখান থেকে বেরিয়ে ২০১০ সালে তাতিন্দ্রলাল চাকমা, সুধাসিন্ধু খীসা, শক্তিমান চাকমা মিলে গঠন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা) নামে নতুন সংগঠন। ২০১৭ সালে ভাঙে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। এই দলের নেতৃত্বের দীর্ঘদিনের বিদ্রোহী একটি অংশ তপনজ্যোতি চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে পৃথক আরেকটি নতুন দল গঠন করে। দৃশ্যত চার ভাগে বিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) তৈরি হয় ভিন্ন মেরুকরণ। বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে এবার ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে একাত্মতা দেখা যায়। অন্যদিকে পাহাড়ের রাজনীতির দীর্ঘদিনের দুই শত্রু শিবির হিসেবে পরিচিত জনসংহতি সমিতি (সন্তু লারমা) ও ইউপিডিএফ ভেতরেও একধরনের সমঝোতার আঁচ পাওয়া যায়।

আবার এই জনসংহতি সমিতি, জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা), ইউপিডিএফ এবং ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) অনেক নেতা-কর্মী জাতীয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত। জাতীয়তাবাদী আধিপত্যের বিরোধিতা এই সংগঠনগুলোর মূল জায়গায় থাকলেও জাতীয় রাজনীতিতে অনেকেই ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি, বাঙালি’ স্লোগান ধরে। জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দলগুলোতে সেখানে তাদের অবস্থান পাকা করার কথা চিন্তা করে। তাই একই সঙ্গে একই ব্যক্তি বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয় বহন করেন।

‘পাহাড়ি’ যেমন কোনো সমজাতীয় ক্যাটাগরি নয়, তেমনই নয় বাঙালিও। বাঙালিরাও পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘আদি বাঙালি’, ‘সেটেলার বাঙালি’ এবং ‘নয়া বাঙালি’ বলে পরিচিত। তাদের মধ্যে আছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ইত্যাদি রাজনৈতিক ধারায় বিভাজন। আবার পাহাড়িদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতমূলক ঘটনায় তারা আবার একই পাটাতনে দাঁড়ায়।

এই যখন পাহাড়ে রাজনৈতিক সমীকরণ ও প্রতিদিনের হিসাব-নিকাশ, তখন সেখানে শত্রু-মিত্রের হিসাবটাও জটিল। আজকে যে বন্ধু, কালকে সে শত্রু। শঙ্কা, ভয়, সন্দেহ, উদ্বেগ। নারীর মুখের কথা বন্ধ হয়ে যায়, নিশ্বাস বন্ধ হতে থাকে। শঙ্কিত হয়ে ভাবে, এই বোধ হয় আমাকে কেউ অনুসরণ করছে। আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভয়, বাঙালি-ভয়, জনসংহতি সমিতি ও জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) ভয়, আছে ইউপিডিএফ ও ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) ভয়। আছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের ভয়। জীবন তবে কোথায় লুকাবে? যে নিরাপত্তা সব জায়গায় থাকার কথা ছিল, তা এখন অনেকটাই ‘চাওয়া’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মজবুত খুঁটি গাড়ে অবিশ্বাস, সন্দেহ আর ভয়। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। আমরা বুঝি, ভয়ের মধ্যে যে জীবন আটকে থাকে, সেটি আর জীবন থাকে না। আধমরা জীবনগুলো টেনেহিঁচড়ে নিয়েই আমরা আরেকটি নিরাপদ দিনের কথা ভাবি।

জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
[email protected]