ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল

জাতীয় রাজনীতি থেকে ছাত্ররাজনীতির নিশ্চয়ই পার্থক্য আছে। শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়েই মূলত তাদের কাজ। সেই সূত্রে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উন্নয়নেও তারা ভূমিকা রেখে থাকে। পাকিস্তান আমল থেকে ছাত্রসংগঠনগুলো শুধু গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামেই সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়নি, সাংগঠনিকভাবেও নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা বজায় রেখেছে। এমনকি আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগেই সেই ধারার রাজনীতির অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছাত্রসংগঠনগুলোর সম্পর্ক ছিল আদর্শগত। এখন সেই আদর্শের জায়গা দখল করেছে সর্বক্ষেত্রে আনুগত্য। ছাত্রসংগঠনগুলো পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক দলের তল্পিবাহকে।

ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন থাকার বিধান চালু হওয়ার পর থেকেই ছাত্ররাজনীতি স্বতন্ত্র সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। জিয়াউর রহমান ছিলেন সামরিক শাসক। নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে তিনি ও তাঁর উত্তরসূরি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে ‘কঠিন’ করে তুলেছিলেন। কিন্তু সামরিক শাসনামলের সেই মন্দ নজির কেন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো অটুট রাখছে?

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তিন সপ্তাহ আগে ছাত্রলীগের সম্মেলন হলেও এখন পর্যন্ত নতুন কমিটি গঠিত হয়নি। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গণভবন তথা আওয়ামী লীগ সভাপতির দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনিই দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব বাছাই করবেন। সম্মেলনের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো কমিটি বাতিল হয়ে গেলেও তাদের নামেই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। অন্যদিকে ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে রাজিব আহসানকে সভাপতি ও আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের কমিটি হয়েছিল। ‘পকেট কমিটি’ গঠনের অভিযোগ তুলে ছাত্রদলের একাংশ সে সময় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও ভাঙচুরও করেছে। কিন্তু ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি কবে হবে, সেটি এখনো কেউ জানে না। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে ছাত্রদলের নতুন নেতৃত্ব গঠন নিয়ে আলোচনা হলেও সেটি চূড়ান্ত রূপ পায়নি। বিএনপির নেতারা বলেছেন, তাঁরা খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া কিছু ভাবছেন না। সে ক্ষেত্রে যত দিন তিনি কারামুক্তি না পাচ্ছেন, তত দিন ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনেরও সম্ভাবনা নেই।

উল্লেখ্য, ‘আমরা শক্তি আমরা বল’ স্লোগান নিয়ে গঠিত ছাত্রদলের কমিটি গঠনে নির্বাচনের বালাই কখনোই ছিল না। বিএনপির প্রধানই সব সময় ঠিক করে দেন ছাত্রদলের কমিটিতে কারা থাকবেন। তবে গত কয়েক বছর কাউন্সিলরদের ভোটেই ছাত্রলীগের নেতৃত্ব, বিশেষ করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতেন। আওয়ামী লীগের নেতারা তখন ছাত্রলীগে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় বলে ফলাও করে প্রচারও করতেন। কিন্তু সেই নেতৃত্ব সিন্ডিকেট তৈরি করেছে—এই অভিযোগে এবার তাঁরা আবার মনোনয়ন পদ্ধতিতে ফিরে গেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এটিকেই অভিহিত করেছেন ‘নতুন মডেল’। নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত কমিটি যদি সিন্ডিকেট তৈরি করে থাকে, তাহলে মনোনীত কমিটি কী করবে, সেটি অনুমান করা কঠিন নয়।

তবে অভিভাবক সংগঠনের এই কর্তৃত্ববাদ শুধু আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে নয়, ছোট-বড় সব দলেই কমবেশি আছে। এই অচলায়তন থেকে ছাত্ররাজনীতিকে বের করে আনা জরুরি বলে মনে করি।