চেনা স্বজন যখন আচমকা অচেনা ঘাতক

এক শ বছর আগে তুর্কি আর্মেনিয়ায় কিংবা ১৯৪০–এর দশকে নাৎসিদের দখলকৃত ইউরোপে পরিকল্পিত গণহত্যা হয়েছে। আজকের মধ্যপ্রাচ্যেও ‘সফলভাবে’ গণহত্যার ‘আয়োজন’ হচ্ছে। এই সব গণহত্যা বিনা বাধায় চালিয়ে যেতে পারার রহস্যটা কী?

১০৩ বছর আগে অটোমানশাসিত একটি তুর্কি নগরে আর্মেনীয়দের ওপর চালানো গণহত্যার বিষয়ে হার্ভার্ডের তরুণ গবেষক উমিত কার্তের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে সহজেই এই প্রশ্নের উত্তর মেলে।

উত্তর হলো কোনো সরকার যদি গণহত্যা চালাতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাকে স্থানীয় প্রশাসন ও সামাজিক কাঠামোর গণ্যমান্য লোককে অপকর্মে শরিক করতে হবে। বিচারক, নিম্নপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা, কেরানি, আইনজীবী, ব্যাংকার থেকে শুরু গণহত্যার শিকার হওয়ার মানুষের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদেরও এতে জড়াতে হবে। তাহলে ‘নিশ্চিন্তে’ প্রতিপক্ষকে নির্বংশ করা যাবে।

উমিত কার্ত তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় এন্তিপ শহরে ১৯১৫ সালে অটোমানদের চালানো গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করেছেন। শহরটি এখন তুরস্কের গাজিয়ানতেপ শহর নামে পরিচিত। এই শহরে জন্ম নেওয়া কুর্দি আরব বংশোদ্ভূত উমিত কার্তের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে জার্নাল অব জেনোসাইড রিসার্চ-এর সর্বশেষ সংস্করণে।

বিংশ শতকের প্রথম হলোকাস্ট হিসেবে পরিচিত গণহত্যায় অটোমান তুর্কিরা প্রায় ১৫ লাখ আর্মেনীয় খ্রিষ্টানকে হত্যা করে। উমিত কার্তের প্রতিবেদনটি শুধু এন্তিপ শহরের গণহত্যা নিয়ে তৈরি হয়েছে।

এতে তিনি দেখিয়েছেন, এই ছোট্ট শহরে মাত্র কয়েক দিনে ২০ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছিল। অসংখ্য নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। তারপর জীবিত সবাইকে ওই শহর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পূর্ব ইউরোপ থেকে ইহুদিদের বিতাড়নের গল্প এই প্রতিবেদন মনে করিয়ে দেয়।

স্থানীয় দালালেরা যে ঘরবাড়ি, খামার, আঙুরের খেত, ফলের বাগান, কফি হাউস, দোকান, স্কুল, লাইব্রেরি দখল করেছে, সেগুলোকে তারা যুদ্ধ জয়ের পর পাওয়া বৈধ সম্পদ মনে করেছে। এগুলো যাদের সম্পদ, তারা তাদের দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী ছিল। ভুক্তভোগীরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি স্বজনদের মতো দীর্ঘদিন পাশে থাকা প্রতিবেশীরাই তাদের জানমাল ছিনিয়ে নেবে।

আর্মেনীয় হলোকাস্ট, জুইশ হলোকাস্ট কিংবা আধুনিক যুগের মধ্যপ্রাচ্যের চলমান গণহত্যার সঙ্গে প্রতিবেদনের লেখক এই গণহত্যার সাদৃশ্য দেখাননি বা এগুলোর সঙ্গে এর কোনো তুলনাও করেননি। কিন্তু প্রতিবেদনটি পড়লে যে কারও মানসপটে নাৎসিদের দখলকৃত ফ্রান্সের দালাল ও নাৎসি–নিয়ন্ত্রিত ওয়ারশর পোলিশ দালালদের ছবি ভেসে উঠবে। ইয়াজিদি নারীদের হরণ করা ও সিরিয়ার নিনভাহ শহরের খ্রিষ্টানদের নির্বংশ করার জন্য আইএসকে আশ্রয় দেওয়া লাখ লাখ সুন্নি মুসলিমের কথা মনে পড়বে। প্রথম যে প্রতিবেশীরা সহায়তা দিতে ছুটে আসে; যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আক্রমণ ঠেকানোর কথা, দেখা গেছে এই—সবখানে তারা সবাই উল্টো এক জোট হয়ে লুটপাট করেছে, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।

 কার্তের প্রতিবেদনের সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তিপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো স্থানীয় দালালদের সহযোগিতা ছাড়া কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে সংখ্যালঘু জনপদকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হয় না। এন্তিপ শহরকে আর্মেনীয় খ্রিষ্টানমুক্ত করার জন্য অটোমানদের সুন্নি মুসলমানদের সহায়তা দরকার হয়েছিল। সুন্নিরা এই সহায়তা দেওয়ার প্রতিদানে হত্যা ও লুটপাটের বৈধতা পেয়েছিল।

উমিত কার্ত দেখিয়েছেন, এন্তিপ শহরে আর্মেনীয়রা যথেষ্ট সচ্ছল ছিল। এটি অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা মুসলিমদের ঈর্ষান্বিত করেছিল। এই ঈর্ষাই ঘৃণার পরিবেশ তৈরির মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এর পাশাপাশি শাসকদের পক্ষ থেকে এই গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে আর্মেনীয়রা তুরস্কবিরোধী জোটের স্বার্থে কাজ করে থাকে। হিটলার ঠিক এই কায়দায় কমিউনিস্ট ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে নাৎসিদের খেপিয়ে তুলেছিলেন। আর এখন মধ্যপ্রাচ্যে যারা বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে, তারা আইএসের আশ্রয়দাতা, লোকজনের ভাষায় ইসলামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা ‘কাফের’।

ইউরোপের ইহুদিদের যেভাবে প্রথম দিকে নাৎসিদের সমর্থক দালালেরা তেমন কিছু বলত না, সাময়িক গ্রেপ্তারের পর ছেড়ে দিত; এন্তিপেও শুরুর দিকে সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়নি। অন্যান্য শহরে আর্মেনীয়দের মারা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেলেও এখানকার আর্মেনীয়দের ধারণা ছিল, তাদের ভয় নেই; কারণ প্রভাবশালী প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো। তারা তাদের পক্ষ নেবে। অনেকে তাদের পক্ষে কথা বলেছিল।

জার্মানিতে ইহুদি নিধনের বিরুদ্ধে অস্কার শিন্ডলার্সের মতো কিছু নাৎসি অবস্থান নিয়েছিলেন। তুরস্কেও কিছু সাহসী তুর্কি আর্মেনীয়দের ওপর চালানো গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। এন্তিপ থেকে ৬১ মাইল দূরে অবস্থিত আলেপ্পোর গভর্নর সেলাল বে তাঁর শহর থেকে আর্মেনীয়দের তাড়াতে অস্বীকার করেছিলেন। এ কারণে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। পরে ক্রমান্বয়ে এন্তিপের খ্রিষ্টান আর্মেনীয়দের ধ্বংস করে ফেলা হয়।

৩০ জুলাই ৫০টি আর্মেনীয় পরিবারকে এন্তিম শহর ছেড়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্য কোথাও চলে যেতে বলা হয়। প্রথম দিকে বেছে বেছে অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের এলাকা ছাড়তে বলা হয়। বেঁচে যাওয়া একজন আর্মেনীয় স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘আমাদের তুর্কি প্রতিবেশীরা তাদের ঘরে বসে আমাদের নিয়ে গান গাইছিল। আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম, তারা গাইছিল, “কুকুরটি তার নিজের পথে চলেছে একা...”।’ এক সপ্তাহ পরে আরও ৫০টি পরিবারকে তাড়ানো হলো। ওই সময় স্থানীয় একটি কৃষি ব্যাংকের একজন ম্যানেজারের নেতৃত্বে একদল ডাকাত লুটপাট শুরু করল। ১৩ আগস্ট নাগাদ দেড় হাজার অর্থোডক্স আর্মেনীয় ভিটে ছেড়ে হেঁটে আলেপ্পো কিংবা দেইর আল জুর এলাকায় চলে গেল। এরপর আজাব নেমে এল ক্যাথলিক আর্মেনীয়দের ওপর। তারপর প্রোটেস্ট্যান্টদের ওপর।

উমিত কার্ত ওই সময়ের যেসব নথিপত্র জোগাড় করেছেন তাতে দেখা গেছে, এন্তিপ শহরের মোট ৩২ হাজার আর্মেনীয় নাগরিকের ২০ হাজার জনকেই হত্যা করা হয়। আর এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্মীয় নেতারা পর্যন্ত জড়িত ছিলেন। এখন মধ্যপ্রাচ্যে ঠিক একই চিত্র। 

আলেপ্পোর পূর্ব দিকের শহর হাফতার থেকে আইএস জঙ্গিরা পিছু হটার পর আমি সেখানে গিয়ে স্থানীয় আইএস আদালতের কিছু নথি দেখেছি। নথি দেখে বুঝতে পেরেছি, এখানকার লোকজনের একটি অংশ তাদের ভাইদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আইএসকে এখানে এনেছিল। বুঝতে পেরেছি, এটি নতুন কিছু নয়; বরং নতুন কিছু হলো আমরা সবই ভুলে যাই।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া

রবার্ট ফিস্ক দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি