দয়ায় দানে মহীয়ান রমাদান

দান দাতার ইহকালীন ও পরকালীন ফজিলত, সম্মান ও গৌরব বৃদ্ধি করে। তাই তা ইজ্জত-হুরমত ও তাজিমের সঙ্গে সযত্নে প্রদান করতে হয়। দান-সদকা, খয়রাত সসম্মানে পবিত্র মনে প্রাপকের হাতে পৌঁছে দিতে হয়। দানের ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। সম্পদ ব্যয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ খাত পিতা-মাতা। পিতা-মাতা ও ছেলেমেয়ে ছাড়া অন্য সব আত্মীয়স্বজনকেই ফিতরা ও জাকাত প্রদান করা যায়। আত্মীয়দের মধ্যে ভাইবোনের হক সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি শ্বশুর-শাশুড়ি ও বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয় যাঁরা, তাঁদেরও অগ্রাধিকার রয়েছে। রমজানে, ঈদে ও নানা উপলক্ষে তাঁদের হাদিয়া দেওয়া সুন্নত। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা দয়াদাক্ষিণ্য ও করুণা গ্রহণে কুণ্ঠাবোধ করেন। তাই তাঁদের হাদিয়া বা উপহার উপঢৌকন হিসেবে দেওয়াই সমীচীন। এটাই দানের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। জাকাত, ফিতরাও উল্লেখ করে দেওয়া যায়, যাতে গ্রহীতা বিব্রত না হন।

একে অন্যকে উপহার দেওয়া সুন্নত। এতে রয়েছে শান্তি, রহমত ও বরকত। আপনজনদের জন্য সাজসরঞ্জাম কিনুন, তাও সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পুরুষের জন্য সুগন্ধি, মেয়েদের জন্য রং।’ (সুনানে আবু দাউদ)। ইসলাম মানুষের কোনো চাহিদা অপূর্ণ রাখতে বাধ্য করেনি; বরং মার্জিত রুচিসম্মত ও যৌক্তিক উপায়ে তা পূরণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। প্রিয় নবীজি (সা.) তত্কালেও আয়না, চিরুনি, তেল, সুরমা ও মিসওয়াক ব্যবহার করতেন এবং সফরে এসবের সঙ্গে অতিরিক্ত পরিধেয়ও সঙ্গে রাখতেন। (শামায়েলে তিরমিজি শরিফ)। অনেকে ঈদের জন্য জায়নামাজ, টুপি, তাসবিহ, আতর ইত্যাদি কিনে থাকেন। নিজের জন্য কিনুন, আপনজনকে হাদিয়াও দিন। এসব কেনার সময় আপনার সামর্থ্য ও রুচি বিবেচ্য।

আপনজনকে ভালোবাসুন। গরিবকে সম্মান করুন। সবাইকে ক্ষমা করুন। আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নিন, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে তোমার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে, তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ো; যে তোমার প্রতি অবিচার করে, তাকে ক্ষমা করো।’ (মুসলিম শরিফ)। রহমত ও মাগফিরাতের মাসে দয়া ও ক্ষমার অনুশীলন করুন। ক্রোধ ও প্রতিশোধপরায়ণ হওয়া শয়তানি বৈশিষ্ট্য; নাজাতের মাসে এর থেকে মুক্তি লাভে সচেষ্ট হোন। বান্দার সঙ্গে সুসম্পর্ক করুন, আল্লাহর সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে। এই রমজানে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করুন, সালাম-কালাম বিনিময় করুন। সম্ভব হলে পর্যায়ক্রমে সবার বাড়িতে যাওয়ার চেষ্টা করুন। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে বিনা দাওয়াতে যাওয়াও সুন্নত। ঈদের আগেই বা ঈদের ছুটিতে এই অভিযান সম্পন্ন করুন, দেখবেন আপনার ঈদের আনন্দ অনেক বেড়ে যাবে, ঈদের প্রকৃত স্বাদ অনুভব করবেন।

কোনো মুমিন মুসলমানের সঙ্গে তিন দিনের অধিক রাগ করে থাকা বৈধ নয়। যদি কারও সঙ্গে কোনো লেনদেন বা দেনা-পাওনা থাকে, তা শরিয়তসম্মতভাবে ও আইনি উপায়ে আদায়ের চেষ্টা করুন। স্বাভাবিক সম্পর্ক বহাল রাখুন, প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত থাকুন। দুনিয়াতে না পেলে আখিরাতে অবশ্যই পাবেন, থাক না পরকালের জন্য কিছু বাড়তি সঞ্চয়। বিশ্বাসী মুমিন মুসলমানের কোনো কিছুই বৃথা নয়।

হাদিয়া বা উপহার সাগ্রহে গ্রহণ করুন, তা যতই সামান্য হোক না কেন। উপহারদাতাকে উপহার দিয়ে সম্মানিত করুন।

প্রকাশ্যে ও গোপনে দান করুন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা দান প্রকাশ্যে করো তবে তা উত্তম; আর যদি তা গোপনে করো এবং অভাবীদের দাও, তবে তা তোমাদের জন্য শ্রেয়। এর মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের মন্দগুলো মোচন করে দেবেন। তোমরা যা করো আল্লাহ তা অবগত আছেন।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৭১)। দান করে খোঁটা দিতে নেই। এতে দানের ফজিলত বিনষ্ট হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সদ্ব্যবহার সুন্দর কথা ওই দান অপেক্ষা উত্তম, যার পেছনে আসে যন্ত্রণা। আল্লাহ তাআলা ঐশ্বর্যশালী ও পরমসহিষ্ণু। হে মুমিনগণ! তোমরা খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দানকে বাতিল করো না। তাদের মতো যারা তাদের সম্পদ ব্যয় করে লোক দেখানোর জন্য এবং তারা আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাস করে না।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৬৩-২৬৪)। নবীজি (সা.) বলেন, ‘খোঁটাদানকারী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (সুনানে তিরমিজি)।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কল্যাণকামী ও শ্রেষ্ঠ দাতা ছিলেন, আর রমজান এলে তিনি সবচেয়ে বেশি দান করতেন; বিশেষত জিবরাইল (আ.)-এর আগমন হলে তিনি প্রবাহিত বাতাসের মতো দান-খয়রাত করতেন। (মুসলিম শরিফ: ২৩০৮)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী : বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail, com