শিশুরা কী ভাবছে তা আমাদের শুনতে হবে

নিজের কাজের অভিজ্ঞতায় জানি যে শিশুদের অধিকার বিষয়ে আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষের ধারণা খুব সীমিত। তার ওপর আছে নানা বিভ্রান্তি।

সবচেয়ে বেশি ভুল ধারণা শিশুদের অংশগ্রহণের অধিকার নিয়ে। যাঁরা শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন, তাঁরা কমিউনিটি পর্যায়ে অভিভাবকদের থেকে প্রায়ই একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হন, ‘শিশুদের অধিকার আছে তাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে মতামত প্রকাশ করার, এটা শুনে আমরা দ্বিধায় পড়ে যাই। এর মানে কি শিশুরা যা বলবে তার সবই আমাদের শুনতে হবে?’

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ ১২-এ বলা হয়েছে, ‘যে সমস্ত বিষয় শিশুর জীবনকে প্রভাবিত করে সে সকল বিষয়ে নিজস্ব মতামত গঠনে সক্ষম একটি শিশুর স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার থাকবে এবং শরিক রাষ্ট্রগুলো তা নিশ্চিত করবে। শিশুর বয়স এবং চিন্তাশক্তির পরিপক্বতা বিবেচনা করে তার মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।’

আমাদের উচিত সব ক্ষেত্রেই শিশুর মতামতের প্রাধান্য দেওয়া। এর মধ্যে পড়ে বাড়ি, স্কুল, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের একটি মূলনীতি হলো, ‘শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ’।

শিশু যদি এমন কোনো কাজ করতে চায় বা এমন মত প্রকাশ করে, যা তার জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, তবে মা-বাবা বা সংশ্লিষ্ট বড়দের দায়িত্ব হবে তাকে সঠিক নির্দেশনা দেওয়া।

রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব আছে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং শিশুদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত উদ্যোগগুলো পরিকল্পনা করার সময় তাদের মতামত শোনা। কোনো মতামত যদি শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ অথবা অন্য কোনো কারণে গ্রহণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে সেটা শিশুকে বুঝিয়ে বলতে হবে।

গত ২৩ মে অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত শিশুদের সঙ্গে প্রাক্‌-বাজেট (২০১৮-১৯) আলোচনা সভায় থাকার সুবাদে ওপরের বিষয়গুলো ভাবছিলাম। অর্থসচিবের উপস্থিতিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, বিনোদন ও খেলাধুলা-সংক্রান্ত নানা বিষয়ে বাজেট বরাদ্দ নিয়ে ২৮ জন শিশু প্রতিনিধি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তুলে ধরে। এই সুপারিশগুলো এসেছে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

জাতীয় বাজেট ২০১৮-১৯ সামনে রেখে সারা দেশের ৬৪ জেলার ৪ হাজার ৮০০ শিশুর সঙ্গে আলোচনা করা হয়। সেখানে তারা বাজেট নিয়ে তাদের ভাবনা জানায়। পরবর্তী সময়ে আরও যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে কিছু মতামত ও সুপারিশ অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে তুলে ধরার জন্য নির্বাচন করা হয়। শিশুদের মতামত গ্রহণে সহায়তা করে শিশু সংগঠন ন্যাশনাল চিলড্রেনস টাস্কফোর্স (এনসিটিএফ)।

শিশুরা শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি বাজেট বরাদ্দের দাবি জানায়। জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে শতকরা ২০ ভাগ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হোক বলে তারা সুপারিশ করেছে। সব কমিউনিটি ক্লিনিকে সপ্তাহে এক দিনের জন্য শিশু বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা এবং সারা দেশে দরিদ্র শিশুদের জন্য বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করাও শিশুদের সুপারিশে উঠে এসেছে।

অন্য যেসব বিষয়ে শিশুরা সুপারিশ করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চর ও হাওর এলাকায় শিশুদের জন্য বিদ্যালয় ও হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ানো এবং শিক্ষক ও চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা, প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিদ্যালয়ে অবকাঠামো নিশ্চিত করা (যেমন বিশেষ টয়লেট, শিক্ষা উপকরণ, খেলাধুলার সরঞ্জাম, প্রশিক্ষিত শিক্ষক)।

শিশুরা মনে করে, সব জেলায় পূর্ণাঙ্গ শিশুপার্ক নির্মাণ করা প্রয়োজন, যেন তারা খেলার সুযোগ পায় এবং মানসিকভাবে বিকশিত হতে পারে। এ ছাড়া শিশুরা কমিউনিটিভিত্তিক ও জাতীয় পর্যায়ে শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে। শিশুর প্রতি সহিংসতা এবং শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে দেশব্যাপী গণসচেতনতা বাড়ানোয়, ইন্টারনেটে শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এবং বাল্যবিবাহ, যৌন নির্যাতন, মাদক সেবন, শিশুশ্রম নিরোধে প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে শিশুরা সুপারিশ করেছে।

অনেকে মনে করেন যে শিশুদের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে এমন বিষয়গুলোতে কথা বলার জন্য তাদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা, জ্ঞান বাÿ ক্ষমতা নেই। বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিশুদের জীবন নিয়ে বিশেষজ্ঞ কিন্তু শিশুরাই। শিশুরা মতপ্রকাশে সক্ষম এবং তা করতে ইচ্ছুক। কিন্তু যেকোনো প্রক্রিয়ায় শিশুদের অংশগ্রহণ কতটা অর্থপূর্ণ হবে, তা নির্ভর করে বড়রা তাদের কথা শোনার জন্য কতটা তৈরি, তার ওপর। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে শিশুদের অনেক আলোচনা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। শিশুদের সক্রিয়ভাবে সংলাপে অংশ নিতে দেখলে বড়রা বিস্মিত হয়ে যান।

প্রাক্‌-বাজেট আলোচনায় একজন শিশু প্রতিনিধি বলে, ‘আমাদের জন্য কী ধরনের বাজেট বরাদ্দ করা হলো, তা যেমন আমরা জানতে চাই, তেমনি জানতে চাই সেই বাজেট থেকে কতটুকু ব্যয় হলো।’ আলোচনায় উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তারা তার এই দৃঢ় মতপ্রকাশে শিশুদের দক্ষতা বিষয়ে সম্যক ধারণা পান।

অর্থসচিব শিশুদের সুচিন্তিত সুপারিশের প্রশংসা করেন এবং সেগুলো বিবেচনার আশ্বাস দেন। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের নানা উদাহরণ নিয়ে বলা যায়, শিশুদের অংশগ্রহণের ফলে আইন, নীতিমালা ও সেবাদান কার্যক্রমগুলোর মানোন্নয়ন করা সম্ভব হয়। এ ছাড়া অংশগ্রহণ একটি শিশুর দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের সাধারণ মন্তব্য ১৯ (২০১৬)-এ শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ এবং তার প্রয়োগের জন্য সরকারগুলোর প্রতি সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাজেট প্রক্রিয়ায় শিশুর অংশগ্রহণ উৎসাহিত করার প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখনো খুব কম দেশেই বাজেট প্রক্রিয়ায় শিশুদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ রয়েছে। গত বছর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় শিশুদের সঙ্গে প্রাক্‌-বাজেট আলোচনা শুরু করেছে। এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়।

জাতীয় বাজেটে শিশু অধিকার বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখা যাবে বলে শিশুরা আশা প্রকাশ করেছে। সেটা আমাদেরও প্রত্যাশা। আমরা চাই, বাজেটসহ শিশুদের ওপর সরাসরি প্রভাব বিস্তারকারী আইন, নীতি ও প্রকল্প প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের সময় শিশুদের মতামত শোনার বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করে জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে স্থায়ী কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হোক।

লায়লা খন্দকার পরিচালক, চাইল্ড রাইটস গভর্নেন্স অ্যান্ড চাইল্ড প্রোটেকশন, সেভ দ্য চিলড্রেন