'সব চুপ কেউ কিছু বলছে না': বাংলা র‍্যাপসংগীতের তরুণেরা

‘সব চুপ কেউ কিছু বলছে না 

সৎ পথে কেন আর কেউ চলছে না?
ভালো খারাপের আর হয় না কেন বিবেচনা
সোনার বাংলা কি তাহলে শুধু কল্পনা?’

নিঃসন্দেহে গানের কথাগুলো থমকে দেওয়ার মতো। ৫৭ ধারা আর ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের যুগে আজকাল কেই-বা এমনভাবে সত্যি কথা বলার সাহস রাখে? ৩ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডের বাংলা এই ৱ্যাপ গানটিতে উঠে এসেছে হতাশা ও তরুণদের ক্রোধের কথা। গানটির ভিডিও চিত্র দেখে ও শুনে মনে হয়, এতে হতাশার উৎস হচ্ছে একাত্তরের স্বপ্নের বাংলাদেশের সঙ্গে বাস্তবের বাংলাদেশের ফারাক। নৈতিক স্খলনের ও সামাজিক দুর্নীতির প্রেক্ষাপটে সংকুচিত বাক্‌স্বাধীনতার এই প্রেক্ষাপটে ঢাকার ৱ্যাপসংগীতশিল্পী সাকিব খান এবং ভিএক্সেলের ‘সব চুপ’ শীর্ষক গানটি বর্তমানের এক দমবন্ধ বেদনাদায়ক দৃশ্যের চিত্রায়ণ করে। সাকিব খান ৱ্যাপসংগীত শ্রোতাদের কাছে স্কিব খান নামে পরিচিত। ইউটিউবে প্রায় ১ লাখ ৮৮ হাজারের মতো দেখা এই ভিডিও চিত্রটি শুরু হয় দুই তরুণকে দিয়ে, যেখানে দেখা যায় তাঁরা দুজন অক্সিজেন মাস্ক পরে আছেন—হয়তো বা দুর্নীতি, হানাহানির বিষাক্ত বাতাস থেকে বাঁচতে। দেখে মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড ছেলেমানুষি রাগ নিয়ে যেন তাঁরা জিজ্ঞেস করছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম চেতনা ছিল বাক্‌স্বাধীনতা ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ে তোলা। তা থেকে ব্যত্যয় ঘটছে—কিন্তু সবাই চুপ কেন?

অন্য সংগীতের সঙ্গে ৱ্যাপ ও হিপহপের পার্থক্য হচ্ছে, শিল্পীরা এখানে সংগীতের বাঁধাধরা নিয়ম মেনে চলেন না। কবিতার মতো আউড়ে যেতে পারেন গান এবং দৃশ্যায়নও হয় অনেক নাটকীয়। স্কিব খানের মতোই দেশে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছেন ৱ্যাপ ও হিপহপ সংগীতশিল্পীরা। এর মধ্যে তৌফিক, এবিডি, ব্ল্যাক জ্যাং, ফকির লাল মিয়া, জালালী সেট, আপটাউন লোকালস, শ্রী সেন, অদিত, স্টোয়িক ব্লিসের নাম উঠে আসে। গবেষণার সূত্র ধরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখন কেন এই সংগীত? কোনো সহজ-সরল উত্তর মেলেনি। তবে কিছু গান পর্যালোচনা করে যেসব কারণ উঠে এসেছে, এর মধ্যে আছে দেশ ও রাজনীতি নিয়ে হতাশার কথা, তরুণদের ক্রোধের কথা। বিভিন্ন গানে এঁরা তুলে এনেছেন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি, শেয়ারবাজার লুট, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে সরকারের অনমনীয় সিদ্ধান্তের সমালোচনা। রানা প্লাজা ও এ দেশের শ্রমিক অধিকার হরণের গল্প। বিডিআর বিদ্রোহ, জঙ্গিবাদের বিরোধিতাসহ দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা।

যেমন ‘সিভিল সমাজ’ নামের আপটাউন লোকালসের গানে তাঁরা বলছেন, ‘প্রত্যেক ৫টা বছর দেশের পরিস্থিতি বদলায় যায়/কিন্তু সবাই হারায় গেছে/এখন স্বার্থ পর্দার অন্ধকারে, নিজের পকেট ভইরা আরেকজনের পেটে লাথি মারে’। রাজনীতিতে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের এই ছবি আমাদের চেনা। অন্যদিকে তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক তৌফিকের একটি গানে শোনা যাচ্ছে কীভাবে পুঁজিবাদী অর্থনীতি শুষে নিচ্ছে শ্রমিককে। তিনি বলছেন, ‘শোষকে শোষিত তুমি, শোষণে লালিত তুমি/ আঘাতে আঘাতে চূর্ণ প্রলয়ে ধ্বংস তুমি/ অধিকার-স্বাধিকার, পরাধীন চিৎকার/—মানবতার চরম লজ্জা, করো স্বীয় সৎকার/ সংগ্রাম-বিপ্লব মহাযজ্ঞের হুংকার/ মজুরের রক্ত প্রশ্নে নিজের ধিক্কার!’ রানা প্লাজার নিচে নিষ্পেষিত শ্রমিকদের মরদেহের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলে মনে হবে তৌফিক খুব সত্যি কথাই বলছেন। অন্যদিকে পুরান ঢাকা থেকে উঠে আসা গ্রুপ জালালী সেট চিত্রায়ণ করছে ঢাকা শহরকে। এখানে ‘জায়গায় জায়গায় লাগে পয়সাপাতি, (চলে) বোমাবাজি আর চাঁদাবাজি আর বাসের কালো ধোঁয়ার (মতো পঙ্কিল) হচ্ছে রাজনীতি।’ রামপাল নিয়ে জনপ্রতিরোধের ডাক দিতে শোনা যায় স্কিব খানকে। ‘বাঘের বাচ্চা’ গানটিতে বলতে শোনা যায় ‘কৈ সব বাঘের বাচ্চা, তোরা কৈ সব আজ? বাঁচাব বাঘের বাচ্চাদের, আছে সুন্দরবন, প্রয়োজন কিছু সুন্দর মন’।

এঁদের কিছু কিছু গানের কথায় গা শিউরে ওঠে এ কথা ভেবে যে—কী সাহস এঁদের! আবার পরক্ষণেই মনে হয় তরুণেরা তো সাহসীই হবেন। বিশ্বজুড়েই তরুণেরা যখন মনে করেছেন সমাজ ও রাজনীতি তাঁদের স্বপ্ন ও ভাবনাকে ধারণ করছে না, তখনই তাঁরা ৱ্যাপসংগীতকে প্রতিবাদের মাধ্যম করে নিয়েছেন। সত্তরের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের কুইন্স থেকে শুরু হিপহপ ও ৱ্যাপসংগীতের যাত্রা। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি রাষ্ট্রীয় দমন-নিপীড়ন, পুলিশি নির্যাতন আর অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে শুরু হয় হিপহপ ও ৱ্যাপসংগীতের আলোড়ন। স্বাভাবিকভাবেই সেই সব র‍্যাপসংগীতের মধ্যে ছিল রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির প্রতি ক্রোধ। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট শহর থেকে উঠে আশা এমিনেম-এর ডোনাল্ড ট্রাম্পবিরোধী সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল মিডিয়া ও ফেসবুকের আলোচনায়। এখনকার বাংলাদেশের মতোই মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তারাও উপেক্ষিতই ছিলেন। হিপহপ গ্রুপ পাবলিক এনিমি, এনডব্লিউএ ও টুপ্যাক শাকুরদের গান ‘ফাইট দ্য পাওয়ার’ (ক্ষমতার সঙ্গে লড়াই করো), ফা**দ্যা পুলিশ (পুলিশকে আমি পুছি না), টুপাক শাকুরের ‘চেঞ্জ’ (পরিবর্তন) গানগুলো এখন ইতিহাস।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের তরুণেরাও ৱ্যাপসংগীতের মাধ্যমে সমাজ ও রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। টুপ্যাক শাকুর, এমিনেম, এডব্লিউএ, পাবলিক এনিমি তাঁদের অনুপ্রেরণা। তাঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে তাঁরা কোনো বিশেষ সরকারের সমালোচক নন, সরকারে কে থাকল না থাকল, তা নিয়েও তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাঁরা দৈনন্দিন জীবনে রাজনীতি ও দুর্নীতির প্রভাবে পর্যুদস্ত হয়ে হতাশা ও ক্রোধের গান বাঁধেন। তবে বলে রাখা দরকার, হিপহপ ও ৱ্যাপসংগীতশিল্পীরা শুধু রাজনীতি নিয়েই গান করেন না। তাঁদের বেশির ভাগ গানই হচ্ছে প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে। তবে হাতে গোনা কয়েকটি রাজনৈতিক গানই অনেক শক্তিশালী।

এই তরুণেরা তুলনায় এখনো কম হলেও তাঁদের এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গুরুত্ব রয়েছে। নিঃসন্দেহে তাঁরা সমাজের একশ্রেণির তরুণের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাঁদের কিছু গানে দেশ নিয়ে যে হতাশার কথা উঠে এসেছে, তা কয়েক দিন আগে প্রথম আলো ও ওআরজি কোয়েস্ট পরিচালিত এক গবেষণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেখানে দেখা গেছে, ৮২ শতাংশ তরুণ দেশ নিয়ে আশাবাদী নন। আমার বিশ্লেষণে তাঁরা বিভিন্নভাবে দেশে মানব উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কথাই তুলে ধরতে চেয়েছেন। শুধু ইট, বালি আর কংক্রিটের কিছু নিষ্প্রাণ উন্নয়ন দরকারি, কিন্তু বোধ হয় সুশাসন, গণতন্ত্র, বাক্‌স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা—যা প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ মানুষের মর্যাদা দেয়; তার ঘাটতির প্রেক্ষাপটে দেশ নিয়ে তরুণদের এই হতাশার উৎস কী? ভেবে দেখার সময় এসেছে কেন তাঁরা বলছেন, ‘অহনকার পরিস্থিতি আমি কেন বুঝি না, এ সিভিল সমাজে নিজেরে খুইজা পাই না?’

মোবাশ্বার হাসান: গবেষক