কেন চাই ১০০-তে ১০০?

পড়ালেখায় শেখার আনন্দ বাদ গিয়ে চলে এসেছে বেশি নম্বরের বোঝা। আর হারিয়ে যাচ্ছে শৈশবের সহজ আনন্দের সুস্থতা। ছবি: আবদুস সালাম
পড়ালেখায় শেখার আনন্দ বাদ গিয়ে চলে এসেছে বেশি নম্বরের বোঝা। আর হারিয়ে যাচ্ছে শৈশবের সহজ আনন্দের সুস্থতা। ছবি: আবদুস সালাম

এখন ঈদের ছুটি। তবু কেন ঘড়িটা সক্কালবেলা অ্যালার্ম বাজায়? কেন রোজ সকালে উঠে মুখ-হাত ধুয়ে টেবিলে বসতে হয়? সামনে নাকি পরীক্ষা। সেই পড়া তৈরি করতে হবে। ১০০-তে ১০০ পেতেই হবে। ৯৫ পেলেই মা-বাবার মুখ গোমড়া। বেড়ে যাবে আরও পড়ার চাপ। বেড়ে যাবে আরও টিউশন। দুই ঘণ্টা অনেক কষ্টে মন দিয়ে পড়তে হয়। এই দুই ঘণ্টা আকাশ দেখা মানা। জানালা দিয়ে ওই আমে ভরা গাছটার দিকে তাকানো মানা। পোষা বেড়ালছানাটা পায়ে এসে মাথা ঘষলে ওকে আদর করাও মানা।

পড়া তো শেষ। এবার নিশ্চয়ই একটু খেলা যাবে। ‘না’, ‘না’, ‘না’। মায়ের চিৎকার আসে। এবার যেতে হবে ড্রয়িং ক্লাসে। ড্রয়িং টিচারের পেনসিলের টানগুলো ভালোভাবে চর্চা করতে হবে। না হলে স্কুলে ড্রয়িং পরীক্ষায় পুরো নম্বর আসবে কীভাবে? পাশের বাড়ির ওই বন্ধুর মতো হাতে পুরস্কার এলেই না মা বা বাবা ফেসবুকে ছবি পোস্ট করতে পারবেন। কিন্তু শিশুটি তো কখনো জানালার আমগাছটা ভালোভাবে দেখার সুযোগ পায়নি। বুলবুলি পাখিটার দিকে তাকাতে পারেনি। নদীর ধারে বেড়াতে যায়নি। কীভাবে আঁকবে সেগুলো? কীভাবে মনের মতো রং দিয়ে রাঙাবে? দরকার নেই সেসবের। শুধু ড্রয়িং ক্লাসের শিক্ষকের পেনসিলের টানগুলো ভালো করে শিখে নিলেই চলবে। পেতে হবে ১০০-তে ১০০।

এক ঘণ্টার ক্লাস শেষ করে এবার একটু দম নিতে চায় শিশুটি। একটু তো খেলা যাবে। যানজট পেরিয়ে বাসায় আসতে দুপুর গড়িয়ে যায়। এবার সময়মতো গোসল আর খাওয়া। একটু টিভি দেখার সুযোগ মেলে। তারপর জোর করে ঘুমিয়ে যেতে হয়। একটু পরে আবার অ্যালার্ম বাজে। শিশুটি এবার যাবে গানের ক্লাসে। শিশুটির গান গাইতে একটুও ভালো লাগে না। তাতে কী? গাইতেই হবে গান। হতে হবে অলরাউন্ডার। সেই ক্লাসও চলে এক ঘণ্টা। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা। এবার আবার পড়ার পালা। শিক্ষক আসেন। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পরিবেশ, ভূগোল—সব পড়ান। সব মুখস্থ করতে হবে। শিশুটি পড়ে, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’। সে জানে না ছোট নদী কেমন? কেমন করে বাঁকে বাঁকে চলে নদী? জানে না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেমন ছিলেন? কী কী করতেন তিনি ছেলেবেলায়? এসব জিজ্ঞেস করলেই উত্তর আসে, আগে পড়াটা শেষ করতে হবে। এরপর যে আরও অনেক পড়া আছে। পড়াটা পরে বুঝলেও চলবে। আগে মুখস্থ করা চাই। নম্বর পাওয়া চাই। এভাবে শিশুটির আর কোনো কিছুই ভালো করে জানা হয় না। একেকটা বিষয় আর ১০০ নম্বর। একসময় বাংলা, ইংরেজি, গণিত—সবই নম্বর হয়ে যায় শিশুটির কাছে। ১০০-তে ১০০।

কেবল গান আর ছবি আঁকা নয়, শিশুটিকে যেতে হয় নাচের ক্লাসে। কারাতে ক্লাসে, সাঁতারে। শিশুটি বোঝে না তার আসলে কোনটা ভালো লাগে? কোনটাতে আনন্দ। কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে না। সবাই কেবল বলে তাকে সব পারতে হবে। সব। সবটাতে প্রথম হতে হবে। পুরস্কার পেতে হবে। শিশুটি চায় মনের মতো করে ছবি আঁকতে। তার মনের আকাশে দুটি সূর্য আঁকতে চায়। একটির রং নীল আর একটির লাল। তার নদীর রংবেরঙের। কিন্তু সেসব আঁকলেই সবাই বকা দেয়। তাহলে যে নম্বর মিলবে না। শিশুটির মনের রংগুলো তাই মুছে যেতে থাকে। সব কেমন বেরং হয়ে যায়।

রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হয় শিশুটিকে। আবার তো সকালে উঠতে হবে। টিউশনির জন্য, গানের ক্লাসে, নাচের ক্লাসে দৌড়াতে হবে। নইলে পিছিয়ে পড়বে যে। ঈদের ছুটির ১৫ থেকে ২০ দিন পেরিয়ে গেল এভাবেই।

শিশুটি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে। একটি গাছে ঘেরা বাড়ি। একটি সবুজ মাঠ। সে খেলছে আর খেলছে। সারা দিন খেলা। ইশ্‌। একটি পুরো দিন যদি সে কেবল খেলতে পারত।

এখন আর ছুটি হলেও আনন্দ হয় না শিশুটির। ছুটি মানেই তো নতুন রুটিন। সেই রুটিনে ছুটিকে কাজে লাগানোর কথা বলে সবাই। ছুটি শেষ মানেই আবার স্কুল। সেখানে আরও চাপ। আরও নিষেধ। বড়রা ছোটদের তৈরি করছেন নিজেদের ইচ্ছামতো; কিন্তু তাতে করে কচি মনের ইচ্ছা-সাধ-স্বপ্নগুলো যে বনসাই হতে থাকে, সে খবর কে রাখে?

এই শিশু আসলে কেন দৌড়াচ্ছে? কেন খেলতে পারে না সে? কেন শৈশব থেকে বঞ্চিত? শিশুটি জানে না। প্রশ্ন জাগে, তার মা-বাবাও কি জানেন? কিংবা তার শিক্ষকেরা? যাঁরা শিশুদের পড়ার সিলেবাস তৈরি করেন, তাঁরা? কেউ কি উত্তরটা একটু খুঁজবেন?