রংপুর বিভাগের জন্য কি কেউ নেই?

খুব খারাপ লাগে। কষ্ট লাগে। মন খারাপ হয়। রংপুর বিভাগের সব সংবদনশীল মানুষেরই হয়। হয় না শুধু তাঁদের, যাঁরা উন্নয়ন খোঁজেন কিন্তু বৈষম্য দেখেন না। আমাদের অর্থমন্ত্রী তাঁদের একজন। দেশের শাসকগোষ্ঠীর জন্য একটি নির্দিষ্ট এলাকার লোক বছরের পর বছর বৈষম্যের তলানিতে পড়ে থাকবে, এটা কেমন কথা? রংপুরের পার্ক মোড় এলাকায় দাঁড়ালে মনভাঙা দৃশ্য চোখে পড়বে। কুড়িগ্রাম লালমনিরহাটের হাজার হাজার দিনমজুর পার্ক মোড় এলাকায় এসে জড়ো হন। তাঁরা ট্রাকে অথবা বাসের ছাদে যাওয়ার জন্য ভিড় করেন। টাঙ্গাইল কিংবা আরও দূরে কোথাও যান দিনমজুরির জন্য। এ দৃশ্য নিত্যদিনের। ভাবি, এ–ই তো আমাদের উন্নয়নশীল দেশের সিঁড়িতে ওঠা বাংলাদেশ!

কেউ কথা রাখে না
রংপুর বিভাগে শুধু নেই আর নেই। শিল্প-কলকারখানা নেই, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, ভালো যোগাযোগব্যবস্থা নেই, উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ নেই। রংপুর বিভাগ থেকে প্রভাবশালী সচিব নেই, রাজনীতিবিদ নেই। রংপুর বিভাগ থেকে কোনো দিন অর্থমন্ত্রী আসেন না। বিএনপির অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান একবার রংপুর এসেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজে। মঙ্গা কী, সেটা তিনি বুঝতেন না। বোঝার কথাও নয়। সিলেটের একজন মানুষের প‌ক্ষে রংপুরের ক্ষুধার ভাষা জানার কথাও নয়। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে একবারও এ অঞ্চলে আসতে দেখলাম না। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার কোনো ঘোষণা নেই। এতে রংপুর বিভাগের মানুষ একটু টু শব্দটি পর্যন্ত করবে বলে মনে হয় না। বাচ্চা না কাঁদলে মা দুধ দেয় না। রংপুরের মানুষ যদি না চায়, যদি তারা উপলব্ধি না করে, তাহলে তাদের আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।

বাংলাদেশের ৬৪ জেলার সবচেয়ে গরিব ১০টি জেলার ৫টি হচ্ছে রংপুর বিভাগে। রংপুরে ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশ, দিনাজপুরে ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ, লালমনিরহাটে ৪২ দশমিক  শূন্য ৪ শতাংশ, কুড়িগ্রামে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ, গাইবান্ধায় ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ গরিব। রংপুর বিভাগে গড় দারিদ্র্য প্রায় ৪৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের গড় দারিদ্র্য ছিল ৪০ শতাংশ। ২০১০ সালে ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৬ সালে হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বর্তমানে রংপুরের গড় দারিদ্র্য ২০০৫ সালের গড় দারিদ্র্যের চেয়েও নিচে। আরও দুঃখজনক হচ্ছে, ২০১০ সালে রংপুরের গড় দারিদ্র্য ছিল প্রায় ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ২০১৬ সালে তা প্রায় ৪৪ শতাংশ। উন্নয়ন তাহলে কোথায় হলো?

প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ইতিহাস
বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব বিভাগের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কী পদ‌ক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, তার কোনো চেষ্টা আমাদের কাছে গোচরীভূত হয়নি। ২০১১ সালে রংপুর জিলা স্কুলের মাঠে একটি জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, রংপুরের উন্নয়নের দায়িত্ব তাঁর। প্রধানমন্ত্রী এ কথা বললেও তাঁর পারিষদবর্গের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর কথাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। কিন্তু তাও এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।

রংপুর বিভাগের অনুন্নয়নের নেপথ্যে রাজনীতি একটি বড় কারণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের পুত্রবধূ। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বাড়ি রংপুর। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বাড়ি দিনাজপুর। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এ তিনজন মানুষের কাছে রংপুরের মানুষ কখনোই কিছু নিতে পারেনি। এ অঞ্চলে অধিকাংশ সময় সাংসদ নির্বাচিত হয়ে আসছে সরকারের বিরোধী দলের।

২০০১ সালে রংপুরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার নোয়াখালীতে নিয়ে গেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রায় ১০ বছর ক্ষমতায়, কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয় আর স্থাপন করা হলো না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রায় চার বছর আগে। সেটিও হলো না। বাংলাদেশে মোট সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩২টি। তার মধ্যে রংপুর বিভাগের ৮ জেলা মিলে মাত্র ২টি মেডিকেল কলেজ। বাংলাদেশে আর কোথাও এত কম মেডিকেল কলেজ নেই।

দরিদ্র করে রাখার বন্দোবস্ত
সর্বশেষ দুটি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সারা দেশে গড় দারিদ্র্যের হার কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। কিন্তু রংপুর বিভাগের গড় দারিদ্র্যের হার না কমে বরং বেড়েছে ২ শতাংশ। এই দায় কে নেবে? বর্তমান ক্ষমতায় আছে মহাজোট সরকার। তাদের কি এই দায় অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে? সারা দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন রংপুর বিভাগের মানুষ। রংপুর বিভাগের খাদ্যচাহিদার চেয়ে উৎপাদন হয় দ্বিগুণ। সেই বিবেচনায় রংপুর বিভাগ উৎপাদনের জন্য আর ভোগের জন্য সারা দেশ। কী বিচিত্র এ বাংলাদেশ! একটি স্বাধীন দেশে কেন আমাদের আন্দোলন করে দাবি পূরণ করতে হবে?

রংপুরের গরিবানা এতটাই বেশি মাত্রায় যে যখন রংপুর বিভাগ রাজশাহীর সঙ্গে যুক্ত ছিল, তখন রাজশাহী বিভাগকেই গরিব করে রেখেছিল। রংপুর রাজশাহী থেকে আলাদা হওয়ার পর রাজশাহীর সেই কলঙ্কতিলক দূর হয়েছে। রংপুর অঞ্চল যে হঠাৎ করেই গরিব হলো তা কিন্তু নয়। বছরের পর বছর ধরে এ অঞ্চলকে গরিবের পোশাক পরিয়ে রাখা হয়েছে। রাজা যায় রাজা আসে, কিন্তু রংপুরের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। আর এ অঞ্চলের মানুষ শুধু ‌ক্ষোভ পুষে রেখেছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ঐতিহাসিক অনেক বড় বড় আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল রংপুরের জনপদ থেকেই।

সরকার কি আমাদের নয়?
আমরা রংপুরের মানুষ আর কতকাল বৈষম্যের শিকার হব? আর কতকাল পর আমরা বলতে পারব বৈষম্যহীন বাংলাদেশে আছি? আমাদের পূর্বপুরুষ, তারও পূর্বপুরুষ, তারও পূর্বপুরুষ—এভাবে আমরা ইতিহাসের এক দীর্ঘ বৈষম্যপূর্ণ সময় পার করে আসছি। বর্তমান প্রজন্মও সেই বৈষম্যই দেখে যাচ্ছে। আমরা কি তবে উন্নয়নের মূল ধারায় ফিরতে পারব না?

কোনো সময় বাংলাদেশের কোনো জেলা কুড়িগ্রামের চেয়ে কম গরিব হতে পারেনি। দেশের কোনো বিভাগ রংপুর বিভাগের চেয়ে গরিব হতে পারেনি। রংপুরের মানুষের প্রতিবাদ না থাকলেও ইতিহাস লিখে রাখবে, বাংলাদেশে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের কোনো সরকার ক্ষমতায় আসেনি। নতুন অর্থবছরের বাজেট সে কথাটাই আবার নিশ্চিত করল।

তুহিন ওয়াদুদ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও রিভারাইন পিপলের পরিচালক।