জ্বালানি ও বিদ্যুতের পাগলা ঘোড়া ছুটছেই

লক্ষ্য যদি হয় যেকোনোভাবে বিদ্যুতের জোগান, তাহলে কেবল আমদানির চুক্তি সই করে বাকিটা সময় নাকে তেল দিয়ে ঘুমালেও চলে। কিন্তু সাধারণ মানুষের পকেটে গৌরী সেনের মতো টাকা না থাকায় সরকারকে সস্তা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথাও ভাবতে হয়। এ কারণেই বর্তমান সরকারের ধারাবাহিক দুই মেয়াদে এ পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৮ বার, রান্নার কাজে গ্যাসের দাম ৪০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮০০ টাকা, বেড়েছে সিএনজিসহ জ্বালানি তেলের দাম। পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গাড়িভাড়া, বাড়িভাড়া আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে চলা পাগলা ঘোড়া যে আসছে অর্থবছরেও লাগাম ছাড়াই থাকবে, তার ইশারা আছে সদ্য পেশ করা বাজেটে।

অবশ্য দাম বাড়লেও এবার আর অভিযোগ করা যাবে না! কারণ, অর্থমন্ত্রী গত মাসেই সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আগে থেকেই সাবধান করে দিচ্ছি, বিদ্যুতের দাম বাড়বে’ (প্রথম আলো, ৯ মে, ২০১৮)। এ ঘোষণার পরও যদি কেউ উচ্চমূল্য পরিশোধের পূর্বপ্রস্তুতি না নিয়ে থাকেন, তবে সেটার দায় যার যার তার তার! অর্থমন্ত্রী বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘যে রসদ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, সেগুলোর দাম বেড়ে গেছে।’ উনার এই কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। সত্যিই তো! যদি দাম বাড়তে থাকা রসদ দিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিয়ত থেকে থাকে, তবে বেশি দামের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা থেকে সরকারকে আর ঠেকাবে কে!

কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের দায়িত্ব তো শুধু বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া নয়, বরং সস্তা বিদ্যুৎ উৎপাদনের রাস্তা খুঁজে বের করে মানুষের জীবনে স্বস্তি আনাটাও তাঁদের কর্তব্য। এর প্রমাণ পাওয়া যাবে গত সপ্তাহে দেওয়া ভারতের বিদ্যুৎ ও জ্বালানিমন্ত্রীর ঘোষণায়। ওই ঘোষণার বলা হয়, ভারত পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ১ লাখ ৭৫ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ আগামী দুই বছরেই অর্জন করে ফেলবে। কাজেই ২০২২ সালের মধ্যে ভারতের নতুন লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে সৌর-বায়ু-বর্জ্যভিত্তিক ২ লাখ ২৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করা (ইকোনমিক টাইমস, ৫ জুন, ২০১৮)।

বাংলাদেশে সোলার প্যানেলের দাম এশিয়ার অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে বসে ভারতের এই সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে আহামরি কিছু বলে মনে না হওয়াটাই স্বাভাবিক (বণিক বার্তা, ১৫ মার্চ, ২০১৭)। কিন্তু জেনে রাখা ভালো, ভারতে ইতিমধ্যেই সাড়ে তিন টাকারও কম মূল্যে সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড অর্জিত হয়েছে। কৃষিজমির ক্ষতি, অর্থায়ন, মানুষের অনাগ্রহসহ নানান বিষয়কে যখন সৌরবিদ্যুতে বিরুদ্ধে অজুহাত হিসেবে আনা হচ্ছে, ভারত তখন এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ, কৃষিজমিতে সোলার শেয়ারিং, মিনিগ্রিড, মাইক্রোগ্রিডের মতো চিন্তার অভিনবত্বকে কাজে লাগাচ্ছে। বাংলাদেশ যখন আমদানির চুক্তি আর বিল পরিশোধে ব্যস্ত, ভারতে তখন গড়ে উঠছে নিজস্ব শিল্প উৎপাদনব্যবস্থা। আর এ কারণেই ভারতের উইন্ড টারবাইন প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘সুযলোন’ ইতিমধ্যেই বিশ্বে অন্যতম শীর্ষ যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং রপ্তানিকারক কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।

সদ্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ খাতে বরাদ্দ হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ হিসেবে এই খাতের বাজেট শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত বাজেটের সমান! কিন্তু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ খরচের একাংশ প্রযুক্তি উন্নয়ন ব্যয়ের নাম করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের বাজেট হিসেবে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে দেখানো হিসাবগুলো সরাসরি বিদ্যুৎ খাতের বাজেট মেলালে দেখা যায়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ আর কারও ভাগ্যেই জোটেনি। এমনি করেই ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে জনগণ টাকা জুগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীতে কতটা সেবা মিলছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে দায়মুক্তি আইনের মেয়াদ বৃদ্ধি পেতে থাকায় বিদ্যুৎ খাতে অর্থ নয়ছয় করার বিচার চাওয়ার পথটা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে আছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মতো উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ উৎপাদনী কেন্দ্রগুলো চালিয়ে রাখতে ধারাবাহিক লোকসান গুনতে গুনতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পরিণত হয়েছে শীর্ষ লোকসানি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে (ইত্তেফাক, ৪ জুন, ২০১৮)। অথচ আশ্চর্য শোনালেও সত্যি যে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ব্যবসায় লগ্নি করা পুঁজির বিপরীতে কোম্পানিগুলো লাভ তুলছে বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি এবং ভারতের তুলনায় তা প্রায় দ্বিগুণ (বণিক বার্তা, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৭)!

অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, মাত্র চার টাকা প্রতি ইউনিট খরচে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়—এমন অন্তত ১০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশে স্থাপন করা সম্ভব (বাংলা ট্রিবিউন, ৩০ মে, ২০১৮)। কিন্তু এ খাত উন্নয়নে কোনো মনোযোগ নেই। যেমনটা নেই দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে দিয়ে সমুদ্রসীমানার গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলনের ব্যাপারেও। পরিকল্পনাহীনতা আর অর্থায়নসংকটে যখন সম্ভাবনার খাতগুলো এভাবেই ধুঁকছে, ঠিক তখনই চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে অপেক্ষা করছে কাতার থেকে আনা উচ্চমূল্যের এলএনজিভর্তি জাহাজ আর নিয়ম ভেঙে সুন্দরবন থেকে মাত্র সাড়ে ১১ কিলোমিটার দূরত্বে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে এলপি গ্যাস প্ল্যান্ট (প্রথম আলো, ৪ এপ্রিল, ২০১৮)। কাজেই সংসদে গত সপ্তাহে দেওয়া বাজেট বক্তৃতায় দাবি করা জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ধারাবাহিকতা হয়তো আগামী অর্থবছরেও বজায় থাকবে। কিন্তু নীতিগত মৌলিক পরিবর্তন না আনলে তা হবে আসলে জবাবদিহিবিহীন অদূরদর্শী পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা।

মওদুদ রহমান: প্রকৌশলী, জ্বালানি প্রযুক্তিবিষয়ক গবেষক।
[email protected]