অর্থমন্ত্রী আসল সংকট নিয়ে নীরব

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বড় সংকটের কারণ। বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের ঘাটতি আছে, আছে আস্থার অভাব। বিগত কয়েক বছর যাবৎ মোট দেশজ উৎপাদনের অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৩ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও তা দিয়ে কতটা কর্মসংস্থান হবে? ব্যাংকিং খাতের সাম্প্রতিক সংকটের ফলে সুদের হার বেড়ে ১৫-১৬ শতাংশ হয়েছে। উচ্চ সুদের কারণে মূলধন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করে রিটার্ন কম পাচ্ছেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে ঋণখেলাপিদের শাস্তি দাবির মধ্যে দিয়ে তাঁদের উদ্বেগটা বোঝা যায়। বড় বড় কোম্পানির লাভ কমে যাওয়ায় পুঁজিবাজারে দরপতন অব্যাহত রয়েছে। এতে বিনিয়োগ আরও নিরুৎসাহিত হচ্ছে। ২০১৭ সালে নিট বিদেশি বিনিয়োগ তার আগের বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

অবৈধভাবে ব্যাপক হারে পুঁজি পাচারের ফলে জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ছে না। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির হিসাবমতে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সময়কালে গড়ে প্রতিবছর ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশ থেকে অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। কিন্তু এ পুঁজি পাচার রোধের কৌশলগত, আইনি ও রাজনৈতিক পন্থা সম্পর্কে সরকার নীরব।

মূল্যস্ফীতির চাপ
বাজেট রপ্তানি-আমদানির সমন্বয় বিধান অনালোচিত থেকেছে। একইভাবে মুদ্রা বিনিময় হার সামঞ্জস্য বিধান করে মূল্যস্ফীতি হাত থেকে রক্ষা করার কথাও বলা হয়নি। শুধু মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বলা হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মূল্য দিন দিন বাড়ায় টাকা চাপের মুখে পড়েছে। ২০১৭ সালে ডলারের বিপরীতে টাকার ৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটেছে। ফলে সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে সাধারণ মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে ছিল ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। যদিও মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার বেশি, সরকারি হিসাবে তা প্রতিফলিত হচ্ছে না। বেসরকারি সংস্থা কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, ২০১৭ সালে ঢাকা শহরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ, আর সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হলেও তা মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়াচ্ছে না। কারণ মানুষের আয় বাড়লেও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে না। বরং প্রকৃত বিচারে মানুষের আয় কমছে। ২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তির আয় ২০১০ সালের চেয়ে ২০১৬ সালে ২ শতাংশ কমেছে। অবধারিতভাবেই কমেছে প্রকৃত ভোগ। জরিপ বলছে, ২০১০ সালে যেখানে মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ছিল ২৩১৮ কিলো, ২০১৬ সালে তা কমে হয়েছে ২২১০ কিলো। টাকার অঙ্কে পরিবার প্রতি প্রকৃত ভোগ কমেছে ১১ শতাংশ।

চলতি হিসাবে ঘাটতি
রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের শ্লথ গতি এবং আমদানি ব্যয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধি চলতি হিসাবের ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি করেছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) চলতি হিসাবের ঘাটতি রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে ৬৩১ কোটি ৮০ লাখ ডলার হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতির ছিল ৯৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এ সময়ে রপ্তানি আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ০৬ শতাংশ বেড়েছে, অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৬ দশমিক ২২ শতাংশ। এভাবেও ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। এ সময় বাণিজ্য-ঘাটতি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯২ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১৭৩ কোটি ডলার। এ ছাড়া সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যে ৯৭ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ঘাটতি হয়েছে, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত ছিল ২৪৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের খেসারত
ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্য থেকে শৃঙ্খলায় ফিরে আনার বদলে অযৌক্তিক কায়দায় তাদের করপোরেট কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষেরই বেশি লাভ হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এর পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এর সঙ্গে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার অবলোপনকৃত ঋণ যোগ করলে ২০১৭ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জিডিপির সাড়ে ১২ শতাংশ। এ ছাড়া আমদানিসুবিধা হিসেবে সরকারি ব্যাংক প্রদত্ত নন-ফান্ডেড ঋণের একাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের ১৮ হাজার ৮৯১ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড ঋণ নির্দিষ্ট মেয়াদে শোধ না করায় বর্তমানে ফান্ডেড দায়ে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ১৪২ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছে। বেপরোয়া ব্যাংকিং ও খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক খাতে মূলধন-সংকট প্রকট। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি মোট নয়টি ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। ঘাটতি পূরণে সরকারি কোষাগার থেকে প্রতিবছর অর্থের জোগান দেওয়া হচ্ছে। পুনঃ মূলধনের নামে ব্যাংকগুলোকে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে মোট ১৬ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির ১১ শতাংশের বেশি।

রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ও পৃষ্ঠপোষকতা আর্থিক খাতকে প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের জালিয়াতি হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম, বিশেষ করে সরকার সমর্থকদের ঋণ অবলোপন, ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ, ঋণ পুনর্গঠন এবং মন্দ ঋণের আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি আর্থিক খাতকে বিপদগ্রস্ত করে ফেলেছে। সরকারি মালিকানাধীন প্রতিটি ব্যাংকে মূলধনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একই অবস্থা বিরাজ করছে ব্যক্তি খাতের কয়েকটি ব্যাংকে। এ সব ব্যাংকে জনগণের ট্যাক্সের পয়সা দিয়ে মূলধন জোগান দিতে হচ্ছে বা হবে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কোনো বিচারের আওতায় না আনায় আর্থিক অপরাধের মাত্রাও বেড়ে চলেছে। সরকার সমর্থক কোটারিদের নতুন ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এদের হৃষ্টপুষ্ট করতে মন্ত্রিপরিষদ ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন’ সংশোধন করা হয়েছে। এবারের বাজেটেও এই গোষ্ঠীকে তুষ্ট করায় যা যা করার তা করা হয়েছে।

পুঁজি বাজার স্থবির
পুঁজিবাজারে একধরনের দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়েছে। একদিকে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা, অন্যদিকে কোম্পানি লভ্যাংশের হ্রাস শেয়ারবাজারে দরপতন ঘটাচ্ছে, যা প্রকারান্তরে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা বাড়াচ্ছে। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফা কমেছে। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ঋণ বাড়ছে। জানা গেছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত শীর্ষ ৯ কোম্পানির ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের বিপরীতে ঋণের পরিমাণ ২২ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। আবার কোনো কোনো কোম্পানি শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হতাশায় ভুগছেন। তাঁরা বাজারের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। পুঁজিবাজার নিয়ে অনেক কথামালা থাকলেও এবারের বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী নীরবতা পালন করেছেন।

প্রকৃত খাতের ঝুঁকি
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রকৃত খাত ঝুঁকির সম্মুখীন। বিদেশে পণ্য রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ এবং পণ্য রপ্তানি বহুমুখী করতে না পারায় রপ্তানি খাতে আয় ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। অবকাঠামোগত দুর্বলতা উৎপাদন খাত সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। মূলত অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে আস্থার সংকটে।

কৃষি খাতেও বলতে গেলে অগ্রগতি থমকে দাঁড়িয়েছে। সেবা খাতও দক্ষ জনশক্তি ঘাটতিতে ভুগছে। সেবা খাতে ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে বৈধ ও অবৈধভাবে প্রচুর শ্রমিক ও পেশাজীবী এ দেশে নিয়োগ পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমানহারে জনশক্তি রপ্তানিজনিত আয় হ্রাস পাচ্ছে, আবার একই সঙ্গে দেশে কর্মরত বিদেশি পেশাজীবী ও শ্রমিকদের নিয়োগ বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে—এটা অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ। দেশে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য সরকারের কৌশলগত পরিকল্পনা, প্রণোদনা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়নি।

জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে যদি টেকসই প্রবৃদ্ধির ধারায় টেনে আনতে হয়, তাহলে আদিম পুঁজি সঞ্চয়ের পন্থা যেমন দুর্নীতি, অপকর্ম, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন প্রভৃতি অবলম্বনের পরিবর্তে উৎপাদন খাতকে গতিশীল করার কৌশল অনুসরণ জরুরি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বর্তমানে গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকারের অভাব, আইনের শাসন ও জবাবদিহির প্রতি অবজ্ঞা, ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এবং ক্ষমতাশালীদের দ্বারা অর্থনীতিকে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার মারাত্মক প্রবণতা দৃশ্যমান।

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারপারসন, উন্নয়ন অন্বেষণ