সাম্য, সম্মান ও সম্ভ্রমের রমজান

রোজা আমাদের মানবিক গুণাবলি বিকাশে সহায়ক। রোজা পালনের মাধ্যমে ধনীরা গরিবের দুঃখ বোঝে; ক্ষুৎপিপাসার জ্বালা অনুভব করে। বুঝতে পারে অসহায় নিরন্ন মানুষের ও খাদ্যের সম্মান। মর্যাদা দিতে শেখে ক্ষুধাকে ও ক্ষুধার্ত মানুষকে। উপলব্ধি করে, কেন অন্নহীন গরিব মানুষ একমুঠো খাবারের জন্য অন্যের ঘরে কাজ করে। অনুধাবন করে দুস্থ গরিব লোকেরা ধনী হওয়ার লোভে নয়, সম্পদের নেশায় নয়; ভোগ-বিলাসের মোহে নয়; শুধুই জীবন বাঁচানোর তাগিদে সবার অগোচরে দৃষ্টির আড়াল হলে সামান্য বাসি খাবারের প্রতি হাত বাড়ায়। কেন গরিব মা তাঁকে খেতে দিলে নিজে না খেয়ে আঁচলে বেঁধে নেন তাঁর অভুক্ত সন্তানের জন্য। অনুভব করে ক্ষুধায় কাতর মানুষ কেন তার আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়, মর্যাদা ভুলে যায়, মান-ইজ্জত বিকিয়ে দেয় খাবারের জন্য। তাদের ঘৃণা ও উপেক্ষা নয়, তাদের জন্য ভালোবাসা ও সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। এটুকু অনুভূতি যদি জাগ্রত না হয় তা হলে রোজা ও রমজান উপবাস ছাড়া আর কিছুই নয়।

সমাজের অবহেলিত-বঞ্চিত মানুষের জন্য রমজানে দান, খয়রাত, ফিতরা, জাকাত ইত্যাদি খুবই উপযোগী। কিন্তু কখনো কখনো এ মহতী কাজেও অনেকে ভুল পদক্ষেপ নেন। রমজান এলে কোথাও কোথাও দেখা যায় অনেক কাপড় ব্যবসায়ী অসম্মানজনকভাবে জাকাতের কাপড় বিক্রির ব্যানার ঝোলান। যাতে সাধারণত লেখা থাকে ‘এখানে জাকাতের শাড়ি ও লুঙ্গি পাওয়া যায়’। এ ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়ে কিছু কম দামি নিম্নমানের শাড়িকাপড় ও লুঙ্গি বিক্রয় করা হয়।

কোনো কোনো জাকাতদাতাও এমন আছেন, যাঁরা এগুলো কিনে জাকাত হিসেবে গরিবদের মাঝে বিতরণ করেন। যে ব্যবসায়ীরা এ রকম করেন, তাঁরা প্রথমত জাকাতকে অসম্মান করেন, দ্বিতীয়ত জাকাতদাতাকে হীন কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। হাদিস শরিফে আছে মন্দ কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী অনুরূপ মন্দ কাজের সমান প্রতিফল পাবে এবং ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদানকারী সেইরূপ ভালো কাজ করার সমান সুফল পাবে। যেসব জাকাতদাতা এ ধরনের নিম্নমানের শাড়ি-লুঙ্গি জাকাত হিসেবে দিচ্ছেন, তাঁরা একদিকে জাকাতকে অসম্মান করছেন, অন্যদিকে জাকাতগ্রহীতাকেও অমর্যাদা করছেন।

জাকাত করুণার দান নয়, দয়াদাক্ষিণ্য নয়; এটি ফরজ ইবাদত। এটি বঞ্চিতদের পাওনা অধিকার। আল্লাহ তাআলা কোরআনে কারিমে বলেছেন: ‘তাদের সম্পদে বঞ্চিত যাঞ্ছাকারীদের নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে।’ (সুরা-৫১ জারিয়াত, আয়াত: ১৯; সুরা-৭০ মাআরিজ, আয়াত: ২৪-২৫)।

পাওনাদারের টাকা দিয়ে পাওনাদারকে নিম্নমানের কিছু কিনে দেওয়া ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কী? কোরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত কল্যাণ পাবে না, যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয় জিনিস দান করবে। আর তোমরা যা দান করো আল্লাহ তা সে বিষয়ে অবগত।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৯২)।

যেহেতু এটি তাঁর পাওনা সুতরাং প্রাপককে তাঁর পাওনা সসম্মানে প্রদান করতে হবে; যাতে তিনি তা পেয়ে সন্তুষ্ট হন। জাকাত প্রদান করা ফরজ ও সদকা আদায় করা ওয়াজিব; কিন্তু কোনো মানুষকে হেয় জ্ঞান করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, কারও সম্মানহানি করা নাজায়েজ, হারাম ও কবিরা গুনাহ।

ইসলামি বিধান মতে, সদকা ও জাকাত এমনভাবে দেওয়া উত্তম, যা গ্রহীতা স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে মুদ্রা বা টাকাই অগ্রগণ্য, কেননা এর দ্বারা গ্রহণকারী নিজের রুচি ও ইচ্ছামতো প্রয়োজন মেটাতে পারেন। যদি কোনো কাপড়চোপড় বা খাদ্যদ্রব্য অথবা অন্য কোনো বস্তু কিনে দেন, তাহলে মানসম্পন্ন জিনিসই দেওয়া উচিত।

জাকাত, সদকাতুল ফিতর ও যেকোনো ফরজ-ওয়াজিব সদকা, যা নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করতে হয় এবং যেসব শুধুই গরিবের হক; সেসব প্রদান করার ক্ষেত্রে গ্রহীতাকে এমন বলার প্রয়োজন নেই যে ‘এটা জাকাত’ বা ‘এটা ফিতরা’। এমনভাবে না বলাই উচিত; কেননা এতে গ্রহীতা লজ্জিত, অপমানিত ও সংকোচ বোধ করবেন। শুধু ফরজ-ওয়াজিব দান নয়, বরং নফল দান-খয়রাতের মাধ্যমেও কাউকে অসম্মান করা যাবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘উত্তম কথা ও ক্ষমা সেই দান অপেক্ষা উত্তম, যার সঙ্গে অনুগামী হয় যন্ত্রণা।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৬৩)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক