'কুদ্দুইচ্যার বাপের' ফুটবল দর্শন
জীবনের খেলা আসলে ফুটবলের মতোই, কেবল মাঠটা এখানে অনেক বড়, স্ট্রাইকার অনেক এবং গোলপোস্টটা অদৃশ্য। কোন দিক থেকে মাইর আইব টের ভি পাইবেন না! ফুটবল নিয়ে রসের গান শাকিরা একাই গাননি, আমাদের গাঁগেরামের এক কবিয়াল তো রীতিমতো ফুটবল থেকে জীবনের দর্শন বুঝিয়ে ছেড়েছেন। কবিয়ালের দুঃখ, তাঁর জীবনটাও ফুটবলের মতোই লাথি খেয়েই গেল্। ‘মাইনষের জীবনডা রে বন্দু, ফুটবলের লাহান, যে যা পারে লাইথ্যায় তারে, মনে লয় যহন’। তাই ছেলে কুদ্দুসকে শোনাচ্ছেন, ‘কুদ্দুইচ্যা রে তওবা ক’রি বল খেলাটা ছাড়!’ জীবনটাও আসলে ফুটবল খেলার মতোই। জীবনের গোলপোস্টের সামনেও আমাদের নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মাঠে খেলছে নানান খেলোয়াড়, তাদের পায়ে পায়ে ছুটছে জয়-পরাজয়। কেবল অপেক্ষা, কখন আপনার ভাগ্যকে লাথি দিতে দিতে প্রতিপক্ষ ছুটে আসবে। সব বাধা ডিঙিয়ে আসবেই তারা নিয়তির মতো। আর আপনি জালের খাঁচার সামনে মহাকাব্যের বীরের মতো দাঁড়িয়ে আছেন—একা। যেন দাঁড়িয়ে আছেন ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে।
গোলরক্ষকের ট্র্যাজেডিটা দেখুন, সব প্রশংসা গোলদাতার কিন্তু গোল ঠেকানোয় ততটা গৌরব নেই। আপনার দুঃসাধ্য গোল ঠেকানোর কথা সবাই ভুলে যাবে, মনে রাখবে কয়টা গোল খেয়েছেন। রেফারিও স্বৈরাচারীর মতো অন্য খেলোয়াড়ের দোষে আপনাকেই ‘ফ্রি কিক’-এর সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে কিংবা দেবে পেনাল্টি। অথচ সাফল্য-ব্যর্থতা একা কারও না। কিন্তু টিভিতে দেখায়, দলের চেয়ে ব্যক্তি খেলোয়াড়ই বড়, সব কৃতিত্ব স্ট্রাইকারের। ক্লোজ-আপে, স্লো-মোশনে বারবার দেখিয়ে দর্শকের মনে গোলদাতার দেবোপম ছবি গেঁথে দেওয়া হয়। আর গোল যেন দীর্ঘ প্রেমের শেষে চরম পুলক, আধুনিক জীবনের মতো আধুনিক ফুটবলেও যা বিরল।
ফুটবল জীবনের মতোই আকস্মিকতায় ভরা। এখনো পথের ছেলে পেলে বা ম্যারাডোনা বা রোনালদোর পক্ষে জনগণের রাজপুত্র হওয়া সম্ভব। কখন কোথায় কোন তালপাতার সৈনিক বীর হয়ে উঠবে আর কোন বীরের পতন ঘটবে, কখন কোন পরাশক্তি ছোটো দলের কাছে হেরে যাবে, তা কেউ বলতে পারে না। ফুটবলের বড় আকর্ষণ এই নাটকীয় অনিশ্চয়তা—তা কখনো কখনো হয়ে যায় ট্র্যাজেডি। ফুটবল এখনো মানবিক। এ জন্যই ক্রিকেটের বিশ্লেষণ ও কৌশল ঠিক করায় কম্পিউটার যতই জারিজুরি করুক, ফুটবল এখনো কম্পুযন্ত্রের আসরমুক্ত।
এক মনোরোগ চিকিৎসকের মতে, বিষণ্ন ও হতাশ মানুষের উপযুক্ত চিকিৎসা হলো ফুটবল খেলা। দলবদ্ধ খেলা দেয় প্রাণশক্তি, দেয় আত্মবিশ্বাস। শেখায় নিজেকে ভালোবাসতে। যে মানুষটি এমনিতে আনস্মার্ট ও লাজুক, ফুটবলের আলোচনায় তিনিও মুখর। এই খেলা বৃদ্ধের মনে আনে কিশোরের উচ্ছ্বাস আর কিশোরকে করে ইঁচড়ে পাকা ক্রীড়া বিশ্লেষক। ফুটবল হলো জনগণের জন্য আফিম। দরিদ্রদের জন্য প্রতিদিনকার একঘেঁয়েমি আর জীবনযন্ত্রণা সাময়িকভাবে ভুলে থাকার মহৌষধ এই খেলা।
বুদ্ধিজীবী চেনার উপায়ও ফুটবল। খুব কম বুদ্ধিজীবী কিন্তু ফুটবল প্রেমিক। টেলিভিশনের কল্যাণে ফুটবল খেলা হয়ে উঠেছে আধুনিক ধর্ম। ফিফার প্রেসিডেন্ট হলেন তার পোপ। পেলে ও ম্যারাডোনারা হলেন দেবতা। মেসি, রোনালদো, নেইমার, সালাহরা হলেন দেবতাদের অবতার। স্টেডিয়ামের সবুজ মাঠ হলো দেবতা আর অবতারদের লীলাতীর্থ। কোটি কোটি ভক্তের বিশ্বাস, ম্যারাডোনার দক্ষতা ছিল জাদুকরী। এই বীরপূজায় আমির-ফকির, সাদা-কালো, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ—সবারই অধিকার। ভ্যাটিকানে সোনার যিশু আর আমাদের মধুপুরের আদিবাসীদের কাঠের যিশু যেমন একই ভক্তি পান, তেমনি শত-কোটি ডলারে তৈরি স্টেডিয়াম কিংবা ধান-কাটা মাঠের এবড়োখেবড়ো জমি—সবখানেই ফুটবল স্বমহিমায় বিরাজমান। ফুটবল সর্বজনীন, সর্বগম্য ও অপ্রতিরোধ্য।
এবং ফুটবল বিপ্লবী। আদিতে ফুটবল অভিজাত ও ঔপনিবেশিক শাসকদের খেলা হলেও তাদের হাত থেকে এটি চলে আসে সাধারণ মানুষের পায়ে পায়ে। সেজন্যই ব্রিটিশ সাহিত্যিক রুডইয়ার্ড কিপলিং ১৯০২ সালে বলেছিলেন, ফুটবল হলো গেঁয়ো ভূতদের কাদামাখানো খেলা। কারণ, তত দিনে ফুটবলে তাঁদের দাপট শেষ। প্রথম ফুটবল ক্লাব গঠন করেছিলেন রেলশ্রমিক ও জাহাজঘাটার কুলিরা। ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপজয়ী প্যারাগুয়েতেও একসময় খেলাটি অভিজাতদের কুক্ষিগত ছিল। ১৯১৫ সালে তাদের প্রকাশিত স্পোর্টস পত্রিকা লেখে, ‘আমরা যারা সমাজে উঁচু আসনের মানুষ, তাদের শ্রমিকদের সঙ্গে খেলতে বাধ্য করা যাবে না...আজকাল খেলাধুলা যন্ত্রণা আর ত্যাগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
ফুটবল সাধারণ মানুষের পায়ে আসার পর শুরু হয় পাল্টা খেলা। এরই চমৎকার উদাহরণ ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ। মাঠে ব্রিটেনকে হারিয়ে ১৯৮২ সালের ফকল্যান্ড যুদ্ধে পরাজয়ের শোধ নেয় আর্জেন্টিনা। ২০০৪ সালে ইতিহাসে প্রথম কোনো আরব দল ইসরায়েলের জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০০০ সালে বিদ্রোহী চেচনিয়া রাশিয়াকে হারায়। ২০০৪ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক অলিম্পিকের সেমিফাইনালে উঠে জানান দেয়, তারা হারিয়ে যায়নি।
১৯১৫ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে অবিস্মরণীয় এক খেলা খেলেছিল জার্মানি আর ইংল্যান্ড। সেটা ছিল বড়দিন। সীমান্তের দুই পারে দুই পক্ষের সৈন্যরা বন্দুক তাক করে আছে। মাঝখানে ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’। হঠাৎ কোত্থেকে সেই ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডে’ একটা ফুটবল এসে পড়ে। নিমেষেই যুদ্ধের ময়দান হয়ে যায় খেলার ময়দান। অস্ত্র ফেলে সৈন্যরা মাতে খেলায়। দু’পক্ষের অফিসারদের সেদিন অনেক কষ্টে সৈন্যদের বোঝাতে হয়েছিল, তোমরা বন্ধুর মতো খেলতে পারো না, তোমাদের উচিত পরস্পরকে ঘৃণা করা, তোমরা না পরস্পরের শত্রু!
ফুটবলেরও শ্রেণীচরিত্র আছে। যেকোনো হালকা গোলাকার বস্তুকেই গরিবরা ফুটবল বানিয়ে খেলতে পারে, কিন্তু বিশ্বকাপে চলে বহুজাতিক কোম্পানি অ্যাডিডাসের দামি বল। ইতালিতে ১২টি বৃহৎ শিল্প খাতের মধ্যে ফুটবল একটি। একমাত্র স্পেনের ভুবনবিখ্যাত বার্সেলোনা ছাড়া আর সব নামীদামি ক্লাবের মালিকানা ধনকুবেরদের হাতে। খেলোয়াড়দের তাঁরা কেনাবেচা করেন। পেশাদারির নামে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের বানানো হয় সেসব ক্লাবের ‘কর্মচারী’। ফিফার প্রেসিডেন্ট সেপ ব্ল্যাটারকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর সাফ জবাব, ‘ফিফা খেলোয়াড়দের সঙ্গে কারবার করে না, খেলোয়াড়েরা হলো ক্লাবের কর্মচারী।’ এভাবে বিপুল টাকার বিনিময়ে ‘জনগণের দেবতা’ বিক্রি হয়ে যান। পায়ের দামে তাঁরা আত্মা বিক্রি করে দেন এবং হারান স্বাধীনতা। পেশাদার ব্যবসায়ী বললে যেমন মুনাফার জন্য মরিয়াপনাকে বুঝি, পেশাদার সৈনিক বলতে যেমন নির্বিকার হত্যার পারদর্শিতা বোঝায়, তেমনি পেশাদার ফুটবলার কি হৃদয়হীন গোলমেশিন?
যাঁরা চার বছর ছিলেন আর্সেনাল, রিয়াল মাদ্রিদ বা এসি মিলানের ‘পেইড কর্মচারী’, বিশ্বকাপে তাঁরাই হাজির হন জাতীয় জার্সি গায়ে জাতীয় পরিচয়ে—দেশপ্রেমের জয়গান গেয়ে। খেলোয়াড়েরা যখন এ রকম ‘জাতীয়’, তখন বিভিন্ন দেশে তাদের ‘বিজাতীয়’ ভক্তরা আন্তর্জাতিকতাবাদী হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের অগণিত ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-সমর্থক যে পতাকা ওড়ায়, তা কোনো দেশের রাজনৈতিক পতাকা নয়, তা ভালোবাসার পতাকা। দেশ দুটিকে তারা তখন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে উঠিয়ে মনের জমিনে বসায়। এই উদ্যম আর ভালোবাসার তলে-তলে চলে খেলোয়াড়দের বাজার যাচাই, চলে বিজ্ঞাপন কোম্পানি, টেলিভিশন চ্যানেল, স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রি, পর্যটনসহ বহুপক্ষীয় রমরমা বাণিজ্য। বিশ্বকাপ শেষ হলে সফল খেলোয়াড়েরা আবার জাতীয় জার্সি খুলে ক্লাবের জার্সি পরবেন, আবার পদশক্তি বিক্রিতে নামবেন। দেবতারা তখন আবার মানুষ হবেন।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]